আমি কী নালিশ দিব! কী আর বিচার চাইব?
টাইম সিলেট ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ১:০১:২০,অপরাহ্ন ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ | সংবাদটি ৩৬১ বার পঠিত
১৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে সিলেট হার্ট ফাউন্ডেশনে আমার হার্টে ৩ টি রিং বসানো হয়। আলহামদুলিল্লাহ, আমার প্রিয় চিকিৎসক প্রফেসর ডা. খালেদ মহসিন বেশ পরিশ্রম করে রিং বসানোর কাজটি সম্পন্ন করেন। তখনও কোনো সমস্যা হয়নি। আমাকে আইসিইউতে নিভিড় পর্বেক্ষণে রাখা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টা কিংবা ৮টার দিকে দুজন লোক আসেন আমার কাছে। বলেন, আপনার এনজিওপ্লাস্টির সময় উরুতে বসানো দুটি পাইপ/বড় ক্যানোলা রিমুভ করবো। ভয় পাবেন না, লোকাল এনেস্থিসিয়া দেয়া হবে। বলেই তারা আমার ডান পায়ের উরুর গোড়ার দিকের ব্যান্ডেজ খুব দ্রুত আর জোরে খুলে ইনজেকশন পুশ করলেন এবং কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে পাইপ/বড় দুটো ক্যানোলা এক টানে খুলে ফেললেন। সাথে সাথে আমার শরীর ঝিমিয়ে যেতে শুরু করলো। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। অক্সিজেন, হার্টের পালস রেট ৩/৪ সেকেন্ডের মধ্যে ৩০-২৫ এ নেমে আসে। আমার চোখ উল্টে গেল। ঝাপসা দেখছি। একজন আমার বুকে কিল-ঘুষির মত করে চাপ দিচ্ছিলেন এবং আমাকে বারবার বলছিলেন কাশি দিতে। আমি কলিমা পড়ছিলাম আর কাশি দিচ্ছিলাম আর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে এসছিলাম। এসময় একজন খুব দ্রুত একটি ইনজেকশন আমার হাতে পুশ করলেন। সব ডাক্তার, নার্স এসে জড়ো হয়েছেন আমার চারপাশে। তাদের চোখ ভয়ার্ত। চিৎকার চেঁচামেচি শুনছিলাম। সবশেষ মনিটরে চোখ গিয়েছিল, আবছা মনে আছে, একটি দেখেছি শূন্যের কোটায় আরও কোন একটি ১৫/২০ এ ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, এ-ই বোধহয় আমি শেষ। আমি শেষ নিঃশ্বাস ফেলছি। হাত তুলতে গিয়েও শক্তি পেলাম না। নিস্তেজ। কলিজার টুকরো মেয়ে সোহার মুখটা ভেসে উঠলো। কালিমা পড়ছি আর কাশি দিচ্ছি প্রাণ শপে। ভাবছিলাম, হয়ত কাশি দিলে হার্টের সচলতা ফিরে আসবে। হয়ত আল্লাহ নিঃশ্বাস ফিরিয়ে দেবেন তার দয়ার আনুকুল্যে। একসময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। এরপরে আমার আর কিছু মনে নেই।
যখন জ্ঞান ফিরলো, রাত তখন সাড়ে ১১ টার দিকে। দেখলাম, শিয়রে প্রফেসর ডা. খালেদ মহসিন। ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় কথা বলতে পারলাম না। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। পরে শুনেছি, আমি কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের পর্যায়ে চলে গিয়েছিলাম! আমার হার্ট ফেইলিউরের কাছাকাছি ছিল।
কিন্তু কেন? কার দোষে? কোন কারণে? জ্ঞান যখন মোটামুটি ফিরল, সিসিইউর চিকিৎসককে জানতে চাইলে তিনি জানালেন, এমনটি অনেকের হয়। ওই পাইপ/বড় ক্যানোলা খুলতে গেলে প্রেশার কমে যায়। তাই এমন পরিস্থিতি হয়। এটা তেমন কিছু না!
আমি সন্তোষ্ট হলাম না। আসলেই কি তাই? তেমন কিছু না?নাকি ওই দুই লোকের খামখেয়ালিপনার বলি হতে যাচ্ছিলাম আমি? তারা কি ভুলভাবে রিমুভ করছিলেন? তারা কি ভুলভাবে লোকাল এনেস্থিসিয়া দিয়েছেন? নাকি এনেস্থিসিয়া দেয়ার পর বড্ড তাড়াহুড়ো করছিলেন? কারণ এনেস্থিসিয়া দেয়ার পরও আমি খুব ব্যথা পেয়েছিলাম। এমনকি প্লাস্টার রিমুভ করবার সময় উরুর পরো জায়গাটা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিল! এটি কি তাদের অদক্ষতা? রোগির প্রতি চরম অমনোযোগিতা? আমি ‘উহ!’ বলে উঠলে তারা বলেছিলেন, লোকাল এনেস্থিসিয়া দিয়েছেন ব্যথা লাগবে না!
তখন তারা আমার দিকে মনোযোগ দেয়ার চেয়ে খোশগল্পে বেশি ব্যস্থ ছিলেন। এত বড় একটি সেন্সেটিভ কাজে তারা এতটাই বিন্দাস ছিলেন, তার মানে আমার জীবনের মূল্য তাদের কাছে একেবারেই ছিল না। সালমান ফরিদ নামের কেউ একজন তাদের ওমন খামখেয়ালির কারণে ওইদিন মারা গেলে আসলেই তাদের কিছু যেতে-আসতো না। তাদের হয়ে হাসপাতালের সুনাম রক্ষার স্বার্থে কর্তৃপক্ষ মেডিকেলের কোনও একটা অজুহাত দিয়ে পার পাইয়ে দিতেন। কিন্তু আমাকে হারাতো আমার পরিবার। মা-বাবা তাদের সন্তান হারাতো। আমার সন্তান তারা বাবা হারাতো। আমার স্ত্রী তার জীবনসঙ্গী হারাতো। আমার ভাই-বোন তাদের বড় ভাইকে হারাতো। তাদের কিছুই হত না। অনুশোচনাও নয়। হয়ত একটা বিবৃতি আসতো হাসপাতাল থেকে— ‘সিনিয়র সাংবাদিক-কবি-লেখক-কলেজ শিক্ষক সালমান ফরিদের মৃত্যু আসলে ইচ্ছাকৃত নয়, একটি দুর্ঘটনা মাত্র! আমরা তার জন্য ক্ষমা প্রার্থী! তার রুহের মাগফেরাত কামনা করি!’
এই ঘটনার পর আমি কি কারও কাছে নালিশ দিতে পারি? কারও কাছে বিচার চাইতে পারি?
চারদিক অন্ধকার। ধোঁয়াশা। কোথাও শোনার কেউ নেই। দেখার কেউ নেই। সবাই ফাঁদ পেতে বসে আছে শুধু শিকার ধরবে বলে! আকাশের মালিক ছাড়া আমাদের এখন কেউ নেই। তাই চুপচাপ!
তবে লাখো শুকরিয়া সেই মহান রাব্বে কারিমের দরবারে। যিনি সব বিপদ থেকে তার মায়ার ছায়ায় রেখে উদ্ধার করে এনে আমাকে আপন নীড়ে পৌঁছে দিয়েছেন।
ফেসবুক থেকে কপি