যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে সিলেটে পবিত্র ঈদুল আযহা উদযাপিত
টাইম ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:১২:২৭,অপরাহ্ন ১৪ আগস্ট ২০১৯ | সংবাদটি ৩৭৭ বার পঠিত
যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে পবিত্র ঈদুল আযহা উৎসবের আমেজে সারাদেশের মত হযরত শাহ জালাল(রহ.) ও হযরত শাহ পরান (রহ.)সহ ৩৬০ আউলিয়ার স্মৃতিবিজড়িত পুণ্যভূমি সিলেটে গত সোমবার উদযাপিত হয়েছে।
এ দিন ত্যাগের মহিমা এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সাধ্যমতো পশু কোরবানি দিয়ে এবং তা আত্মীয়-স্বজনসহ গরিব-দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন সারাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা।
মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবের একটি ঈদুল আযহা। সারাবিশ্বের মুসলমানরা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও করুণা লাভের জন্য হযরত ইব্রাহিমের (আ.) এর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)কে আল্লাহর রাহে কোরবানির প্রতীকী ত্যাগের ঐতিহ্য অনুসরণে ১০ জিলহজ্ব পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন।
সোমবার সিলেটে প্রখর রোধ ও প্রচন্ড তাপদাহ বৈরী আবহাওয়ায় চোখ রাঙ্গালেও ঈদের নামাজ শেষ হয়েছে বৃষ্টি শঙ্কার মধ্যেই। প্রতিবারের মতো এবারও সিলেটের বৃহত্তম ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয় সিলেট নগরীর শাহী ঈদগাহে সকাল ৮টায় । সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লাখো মানুষ এই ঈদগাহে ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করেছেন। জামাতে ইমামতি করেন বন্দরবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম হাফিজ মাওলানা কামাল উদ্দিন। এর আগে ওয়াজ করেন হাফিজ মাওলানা মুফতি ওলিউর রহমান। সবুজে আচ্ছাদিত নয়নাভিরাম পরিবেশে শাহী ঈদগাহে ঈদের নামাজে জমায়েত মানুষের সারি পার্শ্ববর্তী কয়েকটি রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন শাহী ঈদগাহে এবার ঈদের জামাতে সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন। এছাড়া, দরগাহে হযরত শাহজালাল (রহ.) জামে মসজিদে ঈদুল আযহার জামাত সকাল সাড়ে ৮টায় ও হযরত শাহপরান (রহ.) মাজারের মসজিদ প্রাঙ্গণে সকাল সাড়ে ৮টায় অনুষ্ঠিত হয়। কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদে জামাত সকাল ৭টায় এবং দ্বিতীয় জামাত সকাল ৮টায় ও তৃতীয় জামাত সকাল ৯টায়, আঞ্জুমানে খেদমতে কুরআনের উদ্যোগে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে ঈদুল আযহার জামাত অনুষ্ঠিত হয় সকাল ৮টায়, সিলেট কালেক্টরেট মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় সকাল ৮টায়,সিলেট জজ কোর্ট জামে মসজিদে সকাল ৮টায়, জামেয়া মাদানিয়া কাজিরবাজার মাদ্রাসায় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় সকাল সাড়ে ৭টায়। জামেয়ার ক্বেরাত বিভাগের প্রধান ক্বারী মুখতার আহমদ এতে ইমামতি করেন।
কামালবাজার পঞ্চগ্রাম শাহী ঈদগাহ ময়দানে পবিত্র ঈদুল আযহার জামাত সকাল ৮টায় অনুষ্ঠিত হয়। নামাজে ইমামতি করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন হবিগঞ্জের উপ পরিচালক ও বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা শাহ মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম।টিলাগড়স্থ শাহ মাদানী ঈদগাহ ময়দানে পবিত্র ঈদুল আযহার জামাত সকাল ৮টায়,নগরীর ডাক বাংলা রোড নবাবী জামে মসজিদ ওয়াকফ এস্টেটে পবিত্র ঈদল আযহার জামাত সকাল ৮টায়,শেখ মৌলভী ওয়াকফ এস্টেট জামে মসজিদ মাছিমপুর ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় সকাল সাড়ে ৮ টায়,দক্ষিণ সুরমার সিলাম শাহী ঈদগাহ ময়দানে পবিত্র ঈদুল আযহার প্রথম জামাত সকাল ৭টায় এবং দ্বিতীয় জামাত সকাল ৮টায় অনুষ্ঠিত হয়। সিলাম চকের বাজারস্থ এই ঈদগাহ ময়দানে সিলাম গ্রামের ৯টি পাড়ার মুসল্লিরা ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এক সাথে ঈদগাহ ময়দানে সমবেত হয়ে ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করেন। টুকেরবাজার শাহী ঈদগাহ ময়দানে পবিত্র ঈদুল আযহার জামাত সকাল সাড়ে ৮টায় অনুষ্ঠিত হয়।এছাড়াও সিলেট নগরীর বিভিন্ন স্থানে মসজিদগুলোতে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
নামাজ শেষে দেশেবাসীর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত শেষে মুসল্লিরা পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি ও কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
ঈদের নামাজের পরপরই শুরু হয় পশু কোরবানি। সারা দেশের মত সিলেটের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার অলি-গলিতে গরু-ছাগল কোরবানি করা হয়। পরে কোরবানির বিধান অনুযায়ী গোশত বিতরণ করা হয় আত্মীয়-স্বজন ও দরিদ্রদের মধ্যে। নগরীর বহু মানুষ ঈদে গ্রামের বাড়ি যাওয়ায় সিলেট নগরী অনেকটাই ফাঁকা হয়ে পড়ে। বড়দের সঙ্গে নতুন আর বাহারি পোশাক পরে আনন্দে মেতে ওঠে শিশুরা।
ঈদুল আযহা উপলক্ষে গত সোমবার সরকারি ও বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সাজানো হয় মনোরম সাজে। ঈদ উপলক্ষে ঈদের দিন বিভিন্ন হাসপাতাল, কারাগার, সরকারি শিশু সদন, ছোটমণি নিবাস, সামাজিক প্রতিবন্ধী কেন্দ্র, আশ্রয়কেন্দ্র, ভবঘুরে কল্যাণ কেন্দ্র ও দুস্থ কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হয়।
সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দিদের মধ্যে ঈদের আনন্দ বিলিয়ে দিতে বিশেষ খাবারের আয়োজন করে কারাগার কর্তৃপক্ষ। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার সুত্র জানায়, ঈদের দিন সকালে কারাগারের বন্দিদের নাস্তা হিসেবে দেওয়া হয় সেমাই মুড়ি, দুপুরে সাদা ভাতের সঙ্গে মুগডাল ও মুরগির মাংস, রাতের খাবারে দেওয়া হয় পোলাও গরু/খাসির মাংস, সালাদ, মিষ্টি ও কোমল পানীয়। এছাড়া,খাবার দাবারের পাশাপাশি চিত্তবিনোদনের আয়োজন করা হয়।
এদিকে, ঈদের দিন বিকেল থেকে হযরত শাহজালাল (র.) ও হযরত শাহ পরাণ (র.) এর মাজার জিয়ারত করতে এবং নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই লীলা ভূমি প্রকৃতি কন্যা সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে মানুষের ঢল নেমেছে।
হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আযহা পালিত হয়। আরবি ‘আযহা’ এবং ‘কোরবান’ উভয় শব্দের অর্থ হচ্ছে উৎসর্গ। কোরবানি শব্দের উৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে আত্মত্যাগ, আত্মোৎসর্গ, নিজেকে বিসর্জন, নৈকট্য লাভের চেষ্টা ও অতিশয় নিকটবর্তী হওয়া ইত্যাদি।
ইসলামের পরিভাষায় কোরবানি হলো-নির্দিষ্ট পশুকে একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে তারই নামে জবেহ করা। মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে জবাই করা পশুর গোশত বা রক্ত কিছুই পৌঁছায় না, কেবল নিয়ত ছাড়া। ঈদুল আযহার অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে, মনের পশু অর্থাৎ কুপ্রবৃত্তিকে পরিত্যাগ করা।
আল্লাহর বান্দারা কে কতটুকু ত্যাগ ও খোদাভীতির পরিচয় দিতে প্রস্তুত এবং আল্লাহর নির্দেশ পালন করেন; তিনি তা-ই প্রত্যক্ষ করেন কেবল। প্রত্যেক আর্থিক সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। কোরবানির ইতিহাস সুপ্রাচীন। হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নাত অনুসরণ করেই বিশ্বের মুসলমানেরা ১০ জিলহজ্ব কোরবানি দিয়ে থাকেন। হযরত ইব্রাহিম (আ:) স্বপ্নে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানির জন্য মহান আল্লাহর নির্দেশ পেয়েছিলেন। পরপর দু’বার তিনি পশু কোরবানি করেন। তৃতীয়বার একই নির্দেশ পেয়ে তিনি অনুধাবন করেন, শেষ বয়সে জন্ম নেয়া পুত্র ইসমাইলের চেয়ে প্রিয় তাঁর কেউ নেই। আল্লাহ পাক তাকেই কোরবানি করতে নির্দেশ দিচ্ছেন। হযরত ইব্রাহিম (আ:) তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আ:)-কে আল্লাহর নির্দেশ জানালেন। শিশু ইসমাইল (আ:) নির্ভয়চিত্তে সম্মতি দিয়ে পিতাকে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পালন করতে বললেন। কোরবানি করতে উদ্যত হযরত ইব্রাহিম (আ:) পুত্রস্নেহে যেন হৃদয় দুর্বল না হয়ে পড়েন, সে জন্য তিনি চোখ বেঁধে নিয়ে পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন। আল্লাহর অপার মহিমায় এ সময় হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর পরিবর্তে দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। হযরত ইব্রাহিম (আ:)-এর অনুপম ত্যাগের অনুসরণে হাজার হাজার বছর ধরে বিশ্বমুসলমানেরা কোরবানি করে আসছেন। তারই নিদর্শনস্বরূপ প্রতি বছর হজ্ব পালনকারীরা কোরবানি দিয়ে থাকেন। একই সাথে দেশে দেশে মুসলমানেরা পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন।
১০ জিলহজ্ব পবিত্র ঈদুল আযহা অনুষ্ঠিত হলেও পরের দু’দিন অর্থাৎ ১১ ও ১২ জিলহজ্বও কোরবানি করার বিধান রয়েছে। সাধারণত উট, দুম্বা, গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া এসব পশুই কোরবানি করার বিধান রয়েছে।