স্রোতহীন মন্থর খোয়াই নদী
টাইম সিলেট ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:০৫:৫১,অপরাহ্ন ০৭ আগস্ট ২০২০ | সংবাদটি ১৩৩৩ বার পঠিত
আব্দুর রাজ্জাক রাজুঃ একসময় খরস্রোতা বলে যে নদীর পরিচিতি ছিল আজ সে স্রোতহীন। ঘোলা পানি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে নীরবে।
ধীর ও শান্তভাবে প্রবাহিত এই নদীর নাম খোয়াই। দেশের পূর্বাঞ্চলীয় আন্তঃসীমান্ত নদী এটি। বাংলাদেশ ও ভারতের সেতুবন্ধন হয়ে বহুকাল ধরে প্রবাহিত এই নদীর উৎপত্তিস্থল ত্রিপুরার আঠারোপুড়া পাহাড়ে।
একেকটি নদী মানুষ ও জনপদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়।
শুধু তা-ই নয়; জীবনধারণের অবলম্বনও হয়ে ওঠে নদী। খোয়াই হবিগঞ্জ জেলার পূর্বপ্রান্ত হয়ে মেঘনায় গিয়ে মিলেছে।
শৈশব থেকে দেখে আসা প্রিয় নদীর প্রসঙ্গ টেনে কথা বলতে গিয়ে চান মিয়ার মুখে আক্ষেপ ঝরে পড়ে। তিনি থাকেন চুনারুঘাট উপজেলার আহম্মদাবাদ ইউনিয়নের বনগাঁও গ্রামে। ওই গ্রামের উপর দিয়েই নদীটি প্রবাহিত।
চান মিয়া বলেন, নদী আর আগের মতো নাই রে বাবা! শৈশবে আমরা কত সাঁতার কাটছি এই নদীর বুকে। কত মাছ ধরেছি সবাই মিলে। হায়রে দিন, কই গেল সব!
কণ্ঠ ভারী হয়ে এলেও তিনি বলতে থাকেন, নদীটা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো মাছও পাওয়া যায় না এখন আর।
একই গ্রামের বাসিন্দা আবদুল মালেক মাস্টার ও খোয়াই নদীর স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমাদের স্মৃতির সঙ্গে মিলে আছে এই খোয়াই। পাহাড় থেকে মহালদাররা বাঁশ কেটে হাজার হাজার বাঁশ নিয়ে আসতো নদীর উপর দিয়ে। এখন সেই দৃশ্য চোখেই পড়ে না।
নদীর বিভিন্ন ঘাট থেকে প্রতিদিন অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
বনগাঁও গ্রামের আরেক বাসিন্দা মো. আব্দুল আহাদ জানান, পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নেমে আসা পলিমাটির স্তূপ জমে যায় দু’পাশে। সেই পলিমাটি ফসলের উর্বরতা বাড়ায়।
পানির সাথে স্রোতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। খোয়াই নদীতে পানি কম বলে স্রোতও কম। পানি কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে ‘খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার’ এবং হবিগঞ্জ জেলার বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, পানি কম থাকার অন্যতম কারণ দুটি। এক. নদী দূষণ অর্থাৎ নদীতে অবৈধ ও অপরিকল্পিতভাবে ক্রমগত বালু উত্তোলন। দুই. নদীটির উৎপত্তিস্থল অর্থাৎ ভারত থেকে এই নদীর পানির উপর বাঁধ নির্মাণ করে নদীর পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ।
এই গবেষক আরও বলেন, খোয়াই নদী এক সময় হবিগঞ্জ শহরের উপর দিয়ে প্রবাহিত ছিল। ৭০’র দশকের শেষে অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নদীটিকে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ‘লুককাটিং’ (নদীর আঁকাবাঁকা গতিপথ সোজা করা) করে শহর থেকে কিছু দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। ’
দুপুরের তীব্র রোদে নদীপাড়ের দিকে নেমে যেতেই চোখে পড়ে শিশুরা আপন মনে আপন আড্ডা জমিয়ে তুলেছে। কেউ নেমে পড়েছে জলকেলিতে। নদীর দিকে তাকালেই জীবনানন্দ দাশ ফিরে আসেন যেন। ফিরে আসে তার বিখ্যাত কবিতা ‘নদী’।
‘রাইসর্ষের খেত সকালে উজ্জ্বল হলো- দুপুরে বিবর্ণ হয়ে গেল
তারি পাশে নদী;
তুমি কোন কথা কও। ’
নদী যে পথ দিয়ে বয় সেখানে মানুষ ও জনপদের আশীর্বাদ ছড়িয়ে পড়ে। অল্প দূরে জাল দিয়ে মাছধরার দৃশ্যও চোখে এলো। মাছের আশায় চলছে বিরামহীন জাল-সাধনা। কিন্তু বর্তমানের খোয়াই নদীতে নেই আগের সেই স্রোত, সঙ্গে হারিয়ে গেছে এর মৎস্যভাণ্ডার!