করোনা

টাইম সিলেট ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:১২:৩২,অপরাহ্ন ২৬ মার্চ ২০২০ | সংবাদটি ৪০৩ বার পঠিত
(গ্রামেগ্রামে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর ছোট্টগল্প)
— সালমান ফরিদ
বাড়ির বাইরে ছৈদালীর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, ‘রমিজ মিয়া, বাবাজি রমিজ মিয়া, বাড়ি আছো?’
রমিজ মিয়া ঘরেই ছিল। ঢাকা থেকে রাতে ফিরেছে। পথে সে কি অবস্থা। যেন পুলসেরাতের পুল পাড়ি দিয়ে বাড়ি এসে পৌঁছেছে রমিজ মিয়া! ‘হ আছি, কে? ও, ছৈদালী কাকা, কেমন আছেন?’
উঠোনে দাঁড়িয়ে ডাকছিলেন ছৈদালী। দরজা খুলে রমিজ মিয়া বেরুলে তিনি দু পা এগিয়ে এলেন। রমিজ মিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ‘হুনলাম তুমি আইছো। দেকতে আইলাম। কেমন আছো বাজান?
বারান্দায় ব্রেঞ্চ রাখা। বসতো বলল রমিজ মিয়া, ‘আছি কাকা, ভালই। আহেন, বহেন। কাকি কেমন আছে? ভাল?’
বসতে বসতে ছৈদালী বললেন, আছে, বেকটি ভালই আছে! তয় বাজান…
— নূর বাণু ভালানি? হেয় কি স্কুলে যায়? পড়াশোনা ছলছে কেমন?
— আছে ভালই! আর অহন স্কুল! কি নাকি করোনা মরোনা দ্যাশে আইছে বাজান। বেবাক কিছু বন্ধ কইরা দিছে। ওর স্কুলও বন্ধ।
— ও, হো কাকা। বন্ধই তো!
— দেহো বাজান, সামনে মেট্টিক পরীক্ষা। ওহন বন্ধ হইলে পড়বো কহন! বোঝতাছি না!
— কিন্তু কাকা, যে রোগ আইছে, করোনা। এইটা ডেনজারাস, এককথায় মারাত্মক! বন্ধ না দিয়া উপায় নাই। বাছন লাগবো আগে!
— তুমিও তো বন্ধ পাইয়া আইছো!
— হো কাকা। কিবায় যে আইছি! আল্লাহ মালুম!
— তুমি আইছো হুইন্না দেকবার আইলাম। ঢাকার কি অবস্থা হেই খবরটাও জানতে পারমু!
— আর কইয়েন না কাকা, মানুষ ভয়ে যে যেদিকে পালাই যাওয়ার যাচ্ছে। করোনা তাইকা বাছতে। এই রোগ যারে ধরে ছাড়ে না!
— তোমার ছেনাজানা কারও হইছে?
— আল্লার শুকরিয়া। হয় নাই কাকা।
রমিজ মিয়া এসময় কথা থামাতে চায়নি, কিন্তু একটি হাঁচি চলে আসায় প্রায় মাঝপথে কথা থামিয়ে হাঁচি দিল। ‘আসলে ঢাকা থাইকা আইছি তো। রাস্তায় সেকি ধুলা। শর্দি শর্দি লাগছে। এজন্য হাঁচি আসতেছে সকাল থাইকা!’
— আর কইও না। রাস্তার যা অবস্থা। উন্নয়ন নাই। মুখে মুখে সব। দেকো, রাস্তাঘাটের বেহাল দশা! কেমনে সুস্থ ভাবে বাড়ি আইবা! বুঝি বাজান!
এসময় আইনুদ্দীন এসে ঢুকলেন রমিজ মিয়ার বাড়িতে। — আরে আইনুদ্দীন কাকাও দেকি!
— হো, তুমি কহন আইলা?
— কাইল রাইতে!
ব্রেঞ্চে বসতে বসতে ছৈদালীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আরে ছৈদালী ভাই দেকি!
— পুলাটারে দেখতে আইলাম।
— করোনার ভয়ে শুনছি বেবাক মানুস ঢাকা চাইরা গেরামে চইলা গেছে!
— ভয়ে মানুষ পালাচ্ছে, কাকা। ভয়ে। ভয়ংকর রোগ।
— তুমি ঠিক আছো তো!
— না, আমারে পাইনি। আলহামদুলিল্লাহ এহনও ভাল আছি।
— যাক বাজান। কি রোগ আইলো কও দেকি।
— কেউই নিরাপদ না।
— না, আমাদের গ্রামে এগুলান আসব না।
— কাকা, বিদেশ থাকি কয়েক লাখ মানুষ দেশো আইছে। সরকার বলতেছে, তারা ছড়াই দিতে পারে।
— তাই নাকি?
— হো! খুব ভয়ে আছে সবাই। সাবধানে থাকতে হইবো। বলে রমিজ মিয়া ঘরের ভেতরে হাঁক দিল, মা, ছৈদালী কাকা আর আইনুদ্দীন কাকা আইছেন৷ চা দাও না একটু।
ভেতর থেকে মায়ের কণ্ঠ শুনতে পেলো রমিজ মিয়া, দিতাছি বাজান!
ছৈদালী বললেন, রমিজ মিয়া, আল্লাহ ভরসা। করোনা আমাদের দেশের মানুষের হইবো না। আমাগো ক্ষতি করবো না। এক হুজুরও নাকি বলছেন, এটা মুসলমানদের রোগ না!
— হয়েই গেছে কাকা। মারাও গেছে কয়েকজন।
— সেইটা বেশি দূর আগাইতে পারবো না। তাছাড়া আমাগো শরীর মানাই নিবো। দেইখো। যে দেশের মানুষ ফরমালিনে অভ্যস্ত হয়া গেছে সেইখানে করোনা ফরোনায় কিছু করতে পারবো না।
— হাহাহহাহা। দারুণ কইছেন কাকা। কিন্তু কাকা, এইটা কাউরে মানতেছে না। যেই ভিড়তেছে, তার কাছেই করোনা পার হইতেছে।
— হুনছি।
এসময় রমিজ মিয়ার কাশি এলে জোরে একটা কাশি দিল!
— তোমার কি শরীর খারাপ কইরা ফালাইছে? কাইল জার্নি কইরা মনে হয়…
আইনুদ্দীনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, হো। ধূলাবালি খাইয়া আইছি তো। আর কি স্রোত। মানুষের।বানের জলের মত মানুষ বাড়ি যাইতেছে ছুটি পাইয়া।
— কি করবো কও। বাড়িতে যাইব না? মা বাপ, স্ত্রী সন্তান আছে!
— সরকার ভয়ে আছে কাকা, এনাদের কেউ যদি করোনা নিয়া গ্রামে যায়…
— নাহ! বাজান গ্রামে কিছু হইব না।
রমিজ মিয়ার মা তখন চা দিয়ে গেলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে আইনুদ্দীন বললেন, শুনছি মসজিদে যাইতেও না কি মানা করছে সরকার।
— না কাকা, মানা করে নাই। বলছে ঘরে নামাজ পড়তে। অনেক মানুষ যায় তো যদি ছড়াই যায়!
— না না! মসজিদ থাইকা ছড়াইব না। আল্লার ঘর থাইকা ছড়াইতে পারে না!
— মক্কা মদিনার গেইট বন্ধ কইরা রাখছে। ভয়ে।
— হেগো ইমান নাই। আল্লারে ভয় না কইরা করোনার ভয়ে বন্ধ করছে। গজব পড়বে। দেইখয়া নিও। আমাদের মসজি বন্ধ হবে না।
—তবুও কাকা সাবধান থাইকেন।
—হো বাবা। সাবধানে থাকা লাগবো। আচ্ছা, উঠি ওহোন। তোমার বাপ কই? নড়াছড়া পাইতাছি না!
— ছৈদালী কাকা৷ বাজান কিছুক্ষণ আগে পাশের গ্রাম কালিজুরি ছোট ফুফুরে দেখতে গেছে। আইজ নাকি আবার তাগো বাড়িতে নিধনপুরের মেহমান আইব!
— ও, আচ্ছা বাজান। উঠি। বাড়িতে আইসো। তোমার কাকি তোমার কথা বলছিল! অনেকদিন দেকে নাই।
— আচ্ছা কাকা, সন্ধ্যার পর যামু এক চক্কর!
আইনুদ্দীন উঠে হাঁটতে লাগলেন। খানিক দূর উঠোনে গিয়ে তিনি জোরে একটা হাঁচি দিলেন। বেশ জোরে শব্দ হলো। রমিজ মিয়া খেয়াল করলো।
— তয় বাজান। আমিও যাই। যাওনের সময় গফুর মিয়ারে দেইখা যাইতে হবে। হার্টে টিং পরাই আসছে। এখন আগের মত, ভাল হয় নাই।
—আহারে। কাকা খুব কষ্ট করছেন। আল্লাহ সুস্থ করে তুলবেন ইনশাআল্লাহ।
ছৈদালীও চলে গেলে রমিজ মিয়া বারান্দা থেকে উঠে ঘরের ভেতরে পা বাড়লো। চৌকাঠ পেরুতেই আবার একটা কাশি দিল। হাতে চায়ের ট্রে ছিল। এমন জোরে কাশি দিল যে অল্পের জন্যে সেটি হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল!
এর ঠিক ১৫ দিন পর!
গ্রামে এখন সব বাড়িতেই করোনা রোগী। পুরো গ্রাম লকডাউন। পাশের কালিজুরি, দূরের নিধনপুরও! নিধনপুরে এখনও কেউ মারা যায়নি, কিন্তু কালিজুরির রমিজ মিয়ার ফুফু মারা গেছেন পরশুদিন। আরও কয়েকজন মারা গেছেন! নিজেদের গ্রামে সবার
আগে মারা গেছেন গফুর মিয়া! ছৈদালী, আইনুদ্দীন কারও রক্ষা হয়নি। রমিজ মিয়ার জীবনে বড় ট্রাজেডি নেমে আসে ঢাকা থেকে ফেরার ৭ দিনের মাথায়। নিজে আক্রান্ত হলেও হসপিটালে যেতে হয়নি। কিন্তু তার বাবাকে হাসপাতালেও নিতে পারেনি। যানবাহন বন্ধ, কেউ ডাকে আসেনি! সবাই ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করছে! মারা যান বাড়িতেই। এসময় মাও ভাইরাসে আক্রান্ত হন। তাকে হাসপাতালে নেয়া গিয়েছিল। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। শ্বাসকষ্টের রোগী, হাঁপাতে হাঁপাতে মারা গেছেন। সে দেখতেও পারেনি! পুলিশ এসে সব লাশ নিয়ে গিয়ে এক জায়গায় দাফন করেছে। সে শুধু জানাজার নামাজটুকু পড়তে পেরেছিল!
-২৬ মার্চ ২০২০
সিলেট।