“পাওনা টাকা আদায়ের আইনগত কৌশল ও ধার দেয়ার সময় করণীয় দিক “
আইনী পরামর্শ
টাইম সিলেট ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:৫০:৫০,অপরাহ্ন ২১ নভেম্বর ২০২১ | সংবাদটি ১১৮৩ বার পঠিত
“পাওনা টাকা আদায়ের আইনগত কৌশল ও ধার দেয়ার সময় করণীয় দিক “
আমরা সামাজিক জীব, সমাজে চলার পথে অনেক বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকে, এই সম্পর্কের মাঝে কখনো কখনো লেনদেনের ব্যাপার গুলো চলে আসে, হয়তো আপনার কোন বন্ধু বা আত্মীয় সমস্যা ই পড়েছে তাকে আপনি সমস্যা থেকে উদ্ধারের জন্য টাকা ধার দেন, আপনি ভাবেন সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার জন্য হলেও আপনার বন্ধু বা আত্মীয় টাকা ফেরত দেবে কিন্তু মাঝে মাঝে আপনি যা ভাবেন তা হয় না। এই জন্য ধারের পরিমান যদি বেশী একটু সাবধান থাকা উচিৎ।
❇ টাকা ধার দেওয়ার সময় যা করবেন :
প্রয়োজনে যদি টাকা ধার দিতেই হয়, তাহলে যতই আপনজন হোক না কেন, তাঁর সঙ্গে আপনি একটি লিখিত চুক্তি করে নিন। ৩০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে একটি চুক্তি করে নিন এবং এই চুক্তিতে কী কারণে কত টাকা ধার দিলেন, তা স্পস্ট করে উল্লেখ করতে হবে। কবে অপর পক্ষ টাকা ফেরত দেবে এবং পুরোটা একসঙ্গে না কিস্তিতে পরিশোধ করবে, তা উল্লেখ করতে হবে। যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা ফেরত না দেয়, তবে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ থাকবে। বিষয়টা স্ট্যাম্প কাগজে উল্লেখ করা দরকার। মনে রাখতে হবে, চুক্তিপত্রটি যেন আইন অনুযায়ী সম্পাদিত হয়। এছাড়া চুক্তিটি নোটারি বা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা সত্যায়িত করে নিতে হবে। চুক্তিপত্র সম্পাদনের সময় সাক্ষী হিসেবে রাখুন কয়েকজনকে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির মাধ্যমে টাকা দেওয়া হয়, তাহলেও চুক্তিপত্র করে নিতে হবে। চুক্তিপত্র ছাড়া আইনের অশ্রয় গ্রহণ করা অনেকটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। অন্যভাবে তার থেকে তারিখ বিহীন একটা চেক নিতে পারেন একাউন্ট লিখে এবং সাইন নিয়ে সিকিউরিটি হিসেবে।
❇পাওনা টাকা আদায়ের আইনগত পদ্ধতি :
যেভাবে টাকা উদ্ধার করা যেতে পারেঃ-
➡ উভয় পক্ষের মধ্যে আপোষ মিমাংসার মাধ্যমে
➡ ফৌজদারী আদালতে গচ্ছিত চেকের বিরুদ্ধে মামলা করে
➡ দেওয়ানী আদালতে মানি স্যুট এর মাধ্যমে;
➡ অর্থ ঋণ আদালতে ঋণ গ্রহীতার বিরুদ্ধে মামলা করে
🔳 আপোষ মিমাংসার মাধ্যমে টাকা উদ্ধারঃ-
আপনি এ ব্যপারে প্রথমে গ্রাম্য আদালতে অভিযোগ করবেন কিংবা এলাকার মাতব্বর/মুরুব্বীদেরকে জানিয়ে তাদের আপনার বৈধ কাগজ দেখিয়ে পাওনা টাকা আদায়ের দেয়ার আহ্বান করতে পারেন। এক্ষেত্রে গ্রাম্য আদালত কিংবা মাতব্বর/মুরুব্বীরা আপনাকে এবং পাওনাদারকে ডেকে বৈঠকের মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারেন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই যারা প্রভাবশালী, তার প্রভাবের কাছে স্থানীয় বিচার টিকেনা, এক্ষেত্রে যদি বৈঠকের সিদ্ধান্ত আপনার পক্ষে না যায় তবে হতাশ হবেন না। আপনার উপর কেউ কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারবে না। বৈঠকের সিদ্ধান্ত আপনি যদি না মানেন তবে তাদের পরিষ্কার করে বলে দিবেন যে আমি আপনাদের সিদ্ধান্তে খুশি হতে পারছিনা ফলে আমি আদালতে আইনের শরণাপন্ন হবেন। আইন ও আদালত আপনার পাওনা টাকা ফিরে পেতে আপনাকে যথেষ্ট প্রতিকার দিচ্ছে। এক্ষেত্রে আপনি ফৌজদারী আদালত অথবা দেওয়ানী আদালত দুই আদালতেই আপনার পাওনা টাকা ফিরে পেতে মামলা করতে পারবেন।
🔳 ফৌজদারী আদালতে চেকের মামলার মাধ্যমে টাকা উদ্ধারঃ-
ব্যবসায়িক লেনেদেন পরিচালনা কালে বিক্রেতা বা ঋণদাতা ক্রেতা বা ঋণ গ্রহীতার নিজের হিসাবের নিজ স্বাক্ষরিত চেক জামানত হিসেবে রাখতে পারেন বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্রেতা বা ঋণ গ্রহীতা গৃহীত টাকা পরিশোধে জন্য চেক প্রদান করে থাকেন। এক্ষেত্রে চেকের ৬ (ছয়) মাস মেয়াদ থাকাকালীন সময়ে ঋণ দাতা বা পন্য বিক্রেতা প্রদেয় চেকটি নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট এ্যাক্ট, ১৮৮১ অনুসারে নিম্নলিখিত উপায়ে টাকা উদ্ধার করতে পারেনঃ-
➡ চেকের মেয়াদকালীন সময়ে চেকটি নগদায়নের জন্য ব্যাংক উপস্থাপন করবেন;
➡ চেকটি ডিসঅনার হওয়ার পর ৩০ দিনের মধ্যে আইনজীবির মাধ্যমে ঋণগ্রহীতা বা চেক দাতার বরাবরে লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করতে হবে।
➡ লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণের ৬০ দিনের মধ্যে মামলা করতে হবে।
🔳 দেওয়ানী আদালতে মানি স্যুট এর মাধ্যমেঃ-
নেগোশিয়েব ইন্সট্রুমেন্ট ব্যতীত ব্যবসায়ী লেনদেনের সময় ক্রেতার বা ঋণ গ্রহীতার স্বাক্ষরিত স্বাক্ষরিত অন্যান্য কাগজপত্র দাখিলের মাধ্যমে দেওয়ানী আদালতে টাকা আদায়ের মামলা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে পাওনাদার পাওনা টাকার উপর ২.৫% হারে এডভেলোরেম তৎসহ ১৫% ভ্যাট কোর্ট ফি প্রদান করে মামলা করতে পারেন। এক্ষেত্রে কোর্ট ফি সর্বদা অফেরতযোগ্য বটে। পরবর্তীতে পাওনাদার দেওয়ানী আদালতে ডিক্রী পেলে উক্ত ডিক্রী কার্যকরের মাধ্যমে টাকা উদ্ধার করতে পারেন।
🔳 অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমেঃ-
অর্থঋণ আদালতে মামলা করার অধিকার একমাত্র ব্যাংক ও নন ব্যাংকিং ফিন্যান্সিয়াল ইন্সটিটিউশন গুলোর। অর্থ ঋণ আইনের ১২ ধারা মোতাবেক ঋণ গ্রহনের সময় জামানত হিসেবে গচ্ছিত স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়ের পর বিক্রীত টাকা সমন্বয় শেষে বক্রী টাকা নিয়ে মামলা করতে পারেন। এক্ষেত্রে ২.৫% হারে এ্যাডভেলোরেম কোর্ট ফি প্রদানপূর্বক মামলা করা যাবে। পরবর্তীতে পাওনাদার ডিক্রী পেলে উক্ত ডিক্রী কার্যকরের মাধ্যমে টাকা উদ্ধার করতে পারেন।
🔳 কোন কর্মচারী বেতনের টাকা পাওনা হলে :
কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী যদি নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান হতে কোনো মজুরি বা অন্যান্য আইনসম্মত টাকা পাওনা থাকেন কিংবা তাঁকে পরিশোধ করা না হয়, তিনি যদি শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকের অওতাভুক্ত হন, তাহলে শ্রম আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন। আর যদি শ্রমিক না হন, তাহলে দেওয়ানি আদালতে পাওনা টাকা আদায়ের মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন। যেকোনো মামলা হলে মামলার যেকোনো স্তরে আপস-মীমাংসার মাধ্যমে টাকা পরিশোধের সুযোগ রয়েছে।
সর্বোপরি, থানা কিংবা আদালতে যেখাইেন মামলা করা হোব না কেন সমস্ত সাক্ষ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত যদি সন্তোষ্ট হয় তবে আদালত পাওনাদারের বিরুদ্ধে ডিক্রি জারী করতে পারে। আদালত কি পরিমাণ টাকা জরিমানা করতে পারে? এখানে মূল বকেয়া টাকা প্রদানের জন্য ডিক্রি দিতে পারে, যেমন যে পাঁচ লক্ষ টাকা আত্মসাতের জন্য সেই পাঁচ লক্ষ টাকা প্রদানের জন্য রায় দিতে পারে। পাওনা টাকার উপর সুদ প্রদানের ডিক্রি প্রদান করতে পারে। অর্থাৎ এই যে পাঁচ লক্ষ টাকা দীর্ঘ দিন যাবৎ পাওনাদারের কাছে বকেয়া পরে আছে সেই সময়ের উপর নিদিষ্ট হারে সুদ প্রদানের জন্য আদালত ডিক্রি দিতে পারে। এছাড়া মামলা পরিচালনার ব্যয় পরিশোধের জন্য দেনাদারের বিরুদ্ধে ডিক্রি দিতে পারে। অর্থাৎ এই মামলাটি পরিচালনার জন্য আপনার যে পরিমাণ খরচ হয়েছে সেই খরচও পাওনাদারকে দেওয়ার জন্য আদেশ দিতে পারে আদালত। একই সাথে আরো কিছু ক্ষতিপূরণ দিতে আদেশ দিতে পারে আদালত। একই সাথে পাওনারদারের বিরুদ্ধে দন্ড বা জেল হাজতের ব্যবস্থা করতে পারে আদালত।
অ্যাডভোকেট এম এ সালেহ চৌধুরী
হেড অব চেম্বার, দ্যা চেম্বার অব ‘ল, সিলেট
যোগাযোগ -০১৭১১-৯০১১২৯