অনন্যসাধারণ সেই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ
টাইম সিলেট ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৩৪:৫৭,অপরাহ্ন ০৭ মার্চ ২০২৩ | সংবাদটি ৩০৯ বার পঠিতনূরে আলম সিদ্দিকী:: ৭ই মার্চ সকাল ১০টা। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় চরম উত্তেজনা। এটা কোনো সংঘর্ষের রূপ লাভের উত্তেজনা ছিল না। উত্তেজনা ছিল বঙ্গবন্ধু আজ তাঁর বক্তৃতায় কী বলবেন, তা নিয়ে। জনান্তিকে বলে রাখি, বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীই স্বাধীনতার প্রত্যয়ে সুদৃঢ় থাকলেও মূল রাজনীতির স্রোতধারায় তিনটি অভিমত তখনো কমবেশি সক্রিয় ছিল। আওয়ামী লীগের একটি ভাগ তখনো ধারণা পোষণ করতো, ২৩ বছর পর সরকার গঠনের সুযোগ যখন পেয়েছি, তখন সরকার গঠনের পর সব শোষণের হিসাব পাই পাই করে বুঝে নিয়ে ওদের আমরা নিজেরাই ‘খোদা হাফেজ’ বলে দেবো। এই চিন্তাটি উৎসারিত হয় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার কাছ থেকে। তাঁরই সহকর্মী ও চেতনার উত্তরসূরি, বঙ্গবন্ধুর বাল্যবন্ধু সিরাজুদ্দীন হোসেন এই ধারণাটির সরব প্রবক্তা ছিলেন। প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব খুব সম্ভবত ক্ষমতার প্রলোভনের আঙ্গিকে নয়, প্রত্যয়ের অংশ হিসেবেই ওই কথাটি বিশ্বাস করতেন। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অনেকের সঙ্গে আমরাও সাংবাদিক হিসেবে নয়, বরং ভাবতাম আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চেতনার দার্শনিক।
আরেক দল, যারা কোনো অবস্থাতেই গণতান্ত্রিক ধারার আন্দোলন সফলতার সৈকতে পৌঁছাতে পারে এই চেতনাটিতে বিশ্বাস করতো না বরং ৭০-এর নির্বাচনের ম্যান্ডেট আদায়ের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ তুলতো।
তাঁরা বলতেন, ‘ভোটের কথা বলে যারা, এহিয়া খানের দালাল তারা’, ‘বাংলার অপর নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’, ‘মুক্তির একই পথ, সশস্ত্র বিপ্লব’, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘নির্বাচন নির্বাচন, প্রহসন প্রহসন’। তাঁরা চেয়েছিলেন, ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু একতরফাভাবে জন-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম ঘোষণা করবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা করেননি।
তৃতীয় দলে ছিলাম আমরা। যারা বন্দুকের নলকে শক্তির উৎস হিসেবে কোনো দিনই বিশ্বাস করিনি। আমরা আমাদের শক্তির উৎস হিসেবে পেন্টাগন, ক্রেমলিন অথবা দিল্লির দুর্গকে কোনো দিনই ভাবিনি। মানুষের বুক-নিঃসৃত সমর্থনই আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের মূলশক্তি মনে করেছি। মানুষের হৃদয়-নিংড়ানো আশীর্বাদই আমাদের ৭০-এর নির্বাচনের স্বপক্ষে ম্যান্ডেট এনে দিতে পারবে-এই প্রত্যয়ে উজ্জীবিত ছিলাম।
উল্লিখিত তিনটি শক্তিকেই বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুকৌশলে পোষ মানিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও আমাদের বিশ্বাস ও প্রতীতির প্রতি তাঁর নিরঙ্কুশ আস্থা ছিল। তাঁর সমস্ত সত্তায় বাংলার মানুষের হৃদয় অনুরণিত হতো। এ কারণেই স্বাধীনতা-পূর্বকালে সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে তিনি বাংলার মানুষকে একটি অদৃশ্য ঐক্যের রাখিবন্ধনে বাঁধতে পারলেন। এই তিন মতের সমর্থকেরাই উপস্থিত ছিলেন ৩২ নম্বরে।
মানিক মিয়ার চিন্তার উত্তরাধিকারী হিসেবে সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ আওয়ামী লীগের বেশ কিছু প্রবীণ নেতা বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়েছিলেন, ক্ষমতার পথ ব্যবহার করাই হচ্ছে বাংলার কল্যাণের ও শোষণের প্রতিশোধের একমাত্র উপায়। জন-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা এবং সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি যাঁদের প্রতীতি ও প্রত্যয় ছিল অবিচল, তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আমাদের চেতনার আঙ্গিকে যাঁরা আমার অগ্রজ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, এনায়েতুর রহমান, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ ছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, ম্যান্ডেটের পর আঘাত হানলে জীবনের বিনিময়ে হলেও শুধু প্রতিরোধই নয়, প্রত্যাঘাতও করা হবে।
৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানিদের কূটকৌশলগুলো বিবেচনায় রেখেই তীক্ষè বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে স্বাধীনতার প্রত্যয়দীপ্ত ঘোষণা না দিলে আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়বে। ওরাও আমাদের ওপর হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে। এখানে আত্মপ্রচারের স্বার্থে নয়, ইতিহাসের দায়মোচনের জন্যই বলতে হচ্ছে, আমাদের মতটির প্রতিনিধিত্ব আমাকেই করতে হতো। এটা অন্য কোনো কারণে নয়, আমার প্রতি বঙ্গবন্ধুর অপত্য স্নেহ, কারাগারে দীর্ঘ ১৭ মাস তাঁর সান্নিধ্যে তাঁর মানসিকতাকে উপলব্ধি করার একটা বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলাম আমি।
অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ৭ই মার্চে ৩২ নম্বরের বাসায় সাব্যস্ত হলো- স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে উপস্থিত হওয়ার আগেই উপস্থিত জনতাকে উজ্জীবিত করবে এবং আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো বিস্ফোরিত করবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুসরণ করার জন্য প্রতিটি মানুষকে ইস্পাতকঠিন প্রতীতির আওতায় নিয়ে আসবে। ৩২ নম্বর থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আমরা চার জন- সিরাজুল আলম খান এবং খুব সম্ভবত তোফায়েল আহমেদ একই গাড়িতে রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছাই। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই এক থেকে সোয়া ঘণ্টা আগে এসেই আমরা মূল মাইকের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করি। আমরা মঞ্চে উঠে গেলাম (সিরাজ ভাই তাঁর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যে মঞ্চে ওঠেননি)। বিশাল জনসমুদ্রকে আমরা খণ্ড খণ্ড অগ্নিঝরা বক্তৃতা ও স্লোগানে স্লোগানে শুধু মুখর করিনি, মানুষকে উদ্বেলিত করেছি, উচ্ছ্বসিত করেছি। রেসকোর্সকে আমরা প্রকম্পিত করে তুলি, উপস্থিত জনতার চেতনাকে শানিত করে অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করি। মনি ভাই, রাজ্জাক ভাই, তোফায়েল সাহেব, জাতীয় ৪ নেতাসহ বেশকিছু নেতা মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
৭ই মার্চের ভাষণটি ছিল বাংলার মানুষের হৃদয়ের অনুরণন। ভাষাশৈলী, প্রকাশভঙ্গি, শব্দচয়ন, অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ- সবকিছু মিলে একটা অদ্ভুত রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে স্বাধীনতার পূর্ণ ঘোষণাই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অতি সতর্কতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শব্দচয়নের যে কুশলী পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, তাতে বিচ্ছিন্নতার অভিযোগে অভিযুক্ত করার কোনো সুযোগ তিনি রাখেননি। আমি তাঁর শতাধিক ভাষণ নিজ কানে শোনার সৌভাগ্যের অধিকারী। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তো বটেই, নির্দেশ-নির্দেশনাকে উপলব্ধি ও মননশীলতায় পরিণত করার জন্য এবং তাঁর বাগ্মিতাকে জ্ঞানপিপাসু ঋষি-বালকের মতো অনুশীলন করার জন্য আমি একান্ত চিত্তে তাঁর বক্তৃতা শুধু শ্রবণ করিনি, অনুধাবন করেছি, উপলব্ধি করেছি, আত্মস্থ করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টাও চালিয়েছি। সত্যতার খাতিরে এ বাধ্যবাধকতাকে স্বীকার করতেই হবে, তাঁর নিজের দেয়া কোনো ভাষণের তুলনা ৭ই মার্চের ভাষণের সঙ্গে হতে পারে না।
সেদিন আমাদের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি ছিল- স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে অবশ্যই বজ্রনির্ঘোষে ঘোষিত হবে, কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে বাংলার স্বাধীনতাকামী ও বিশ্বের জাগ্রত জনতাকে আদৌ যেন বিভ্রান্ত করতে না পারে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধুই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, কিন্তু সকল চিন্তার অভিব্যক্তিতে ধৈর্যসহকারে সবার অভিমত শ্রবণ করার অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য তাঁর ছিল। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি শুধু পাকিস্তানের পরাজয়কে সুনিশ্চিতই করেনি, বরং তাঁর ব্যক্তিত্ব ও স্টেটস্ম্যানশিপকে ভিন্ন উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। ৭ই মার্চের ভাষণটি কৌশলগত দিক থেকে এতই নিখুঁত ও নিষ্কলুষ ছিল যে, আজও আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই- দিগন্তবিস্তৃত আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো তাঁর উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হচ্ছে। ৭ই মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার নির্দেশনাটি এতই সুস্পষ্ট ছিল যে (আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি) ২৫শে মার্চ রাতে ওদের পৈশাচিক আক্রমণের পর আর নতুন করে কোনো নির্দেশনার অপেক্ষা রাখে না।
কি অদ্ভুত কৌশলী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বক্তব্য ছিল সেটি! পাকিস্তানি জান্তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। একদিকে তিনি সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, “তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিচ্ছু বলবে না।” অন্যদিকে বলছেন- “আর যদি একটি গুলি চলে- যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।” একদিকে তিনি ইয়াহিয়া খানকে ৪টি শর্ত ছুড়ে দিলেন। অন্যদিকে তিনি নির্দেশনা দিলেন- “আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি… যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।” এই উচ্চারণটি এতটাই সুদূরপ্রসারী ছিল যে, প্রতিটি মানুষ নিষ্কলুষ চিত্তে উজ্জীবিত হলো- শুধুমাত্র শত্রুর আক্রমণকে প্রতিহত করা নয়, শত্রুর যেকোনো সশস্ত্র আক্রমণকে পরাভূত করতে হবে। ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ পাকিস্তানি পৈশাচিক জান্তা এই ভাষণটির মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেনি বলেই তারা ধরে নিয়েছিল, কোন একটি সময়ে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালালে, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করলে- আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাবে, মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ৪ নেতাসহ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় ২০/২৫ জন ব্যক্তিত্বকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তারা তালিকা প্রস্তুতও করেছিল।
ভাষাশৈলী, প্রকাশভঙ্গি, শব্দচয়ন, অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ- সব কিছু মিলে একটা অদ্ভুত রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে স্বাধীনতার পূর্ণ ঘোষণাই প্রদত্ত হয়েছিল ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটিতে। কিন্তু অতিসতর্কতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শব্দচয়নের যে কুশলী পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, তাতে বিচ্ছিন্নতার অভিযোগে অভিযুক্ত করার কোনো সুযোগ তিনি রাখেননি। আমি তার নিজের প্রদত্ত শতাধিক ভাষণ নিজ কানে শোনার সৌভাগ্যের অধিকারী। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তো বটেই, নির্দেশ-নির্দেশনাকে উপলব্ধি ও মননশীলতায় পরিণত করার জন্য এবং তার বাগ্মিতাকে জ্ঞানপিপাসু ঋষিবালকের মতো অনুশীলন করার জন্য আমি একান্তচিত্তে তার বক্তৃতা শুধু শ্রবণ করিনি, অনুধাবন করেছি, উপলব্ধি করেছি, আত্মস্থ করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টাও চালিয়েছি। সত্যতার খাতিরে এ বাধ্যবাধকতাকে স্বীকার করতেই হবে, তার নিজের প্রদত্ত কোনো ভাষণের তুলনা ৭ই মার্চের ভাষণের সঙ্গে হতে পারে না। তিনি তেজস্বী বক্তা ছিলেন। বাগ্মী ছিলেন। এটা অস্বীকার করা না গেলেও ৭ই মার্চে শব্দচয়ন থেকে শুরু করে তার প্রয়োগ এতই কার্যকর ছিল, ওই সভায় উপস্থিত সবার মন ও মননশীলতাকে প্রচ- আবেগে শুধু অভিভূতই করে নাই, স্বাধীনতার চেতনাকে প্রত্যয় ও প্রতীতিতে পরিণতই করে নাই, বরং নিজ আঙ্গিকে সবাই এ প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা নিয়ে ফিরেছে যে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে হলেও পরাধীনতার বক্ষবিদীর্ণ করে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনবে। আমি সমস্ত উপলব্ধি ও সত্তায় আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। আমার স্থির ধারণা, ৭ই মার্চে বাংলাদেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করার জন্য আল্লাহর রহমতে তিনি উজ্জীবিত ছিলেন। ওই ভাষণটি স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিপূর্ণ প্রত্যয় সৃষ্টির লক্ষ্যে সমস্ত জাতীয় চেতনাকে এক অটুট বন্ধনে আবদ্ধ ও অঙ্গীকারাবদ্ধ করেছিল।
ভাষণটি গোটা জাতিকে এমনভাবে উদ্বেলিত করেছিল যে, পৃথিবীর কোনো একক বক্তৃতায় এরূপ দৃষ্টান্ত আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেকেই আবেগাপ্লুত হৃদয়ে, অভিভূত চিত্তে ৭ই মার্চের ভাষণটিকে গ্যাটিসবার্গে আব্রাহাম লিঙ্কনের বক্তৃতার সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। আমি এই তুলনাটি করতে নারাজ। কারণ দুটি বক্তৃতার প্রেক্ষাপট এবং আঙ্গিক ছিল ভিন্নতর। গৃহযুদ্ধ সমাপ্ত আমেরিকার গৌরবদীপ্ত মঞ্চে দাঁড়িয়ে আব্রাহাম লিংকন ওই ভাষণটি দিয়েছিলেন। সামাজিক দুর্যোগের মেঘ সরে গিয়ে যখন আমেরিকার পূর্ব দিগন্তে হাস্যোজ্জ্বল সূর্য উদ্ভাসিত, তখন আমেরিকার বিজয়ী নেতা সারা বিশ্বের জন্য জগৎখ্যাত ভাষণটি দেন (Govt. of the people, by the people, for the people, can’t perish from the earth.) কিন্তু ৭ই মার্চের প্রেক্ষাপটটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলার দিগন্ত বিস্তৃত আকাশে ঘন কালো মেঘে ঢাকা। একদিকে নিদারুণ অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে বুক ভরা প্রত্যাশা। স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস ও আকাক্সক্ষা তখন পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করার জন্য উদগ্রীব। বাংলার মানুষের এই প্রত্যাশাকে সামনে রেখেই ৭ই মার্চের ভাষণটি প্রদত্ত। এখানে অবশ্যই উল্লেখ্য যে, হরতাল, অসহযোগ, অবরোধের মধ্যদিয়ে অহিংস ধারাকে অব্যাহত রেখে চলছিল নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। এর পূর্বে ৩রা মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় বঙ্গবন্ধু অহিংস ও সুশৃঙ্খলভাবে এবং নাশকতার সম্পর্কে সতর্ক থেকে আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানান।
ভাষণটি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পরাজয়কেই কেবল নিশ্চিত করে নি, সমস্ত মানুষের মননশীলতা ও প্রতীতিকে প্রত্যয়ে উজ্জীবিত করেনি, একটা অদৃশ্য রাখীবন্ধনে সমগ্র জাতিকে শুধু আবদ্ধই করেনি, লড়াকু, অকুতোভয় একটি সত্তাকে কুশলী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। শব্দচয়ন- তার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ লক্ষ মানুষের মননশীলতাকে এমনভাবে শানিত করেছে যে, সর্বশ্রেণি ও পেশার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সকলেই যা শুনতে এসেছিলেন, ঠিক তাই শ্রবণ করে স্বাধীনতার দৃপ্ত শপথে উজ্জীবিত হয়ে সেদিন ঘরে ফিরেছেন।
ওই উজ্জীবিত জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ভাষণটি প্রতিটি মানুষের হৃদয়বন্দরে গ্রথিত রয়েছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সেদিনের ভূমিকাটি কেন জানি না কেউই উল্লেখ করেন না। শাসনতান্ত্রিক ও সংসদীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় যে কথাগুলো বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সরাসরি উচ্চারণ করা সম্ভব হতো না- তাঁরই নির্দেশে তাঁর উত্তরাধিকার হিসেবে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সেই নির্দেশনাগুলো সংবাদপত্র, সভা-সমাবেশ ও মিছিলের মাধ্যমে সারা বাংলার বাতাসে ছড়িয়ে দিতো এবং পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সেটি পালিত হতো। ৭ই মার্চ বাঙালির জাতীয় চেতনার সফলতা, সার্থকতা এবং তাদের চেতনাকে ঐতিহাসিক বাস্তবতায় রূপান্তরিত করার অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত।
লেখক: স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি।