লিবিয়া নিয়ে যে আতঙ্ক সিলেটে
টাইম সিলেট ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৪২:২৮,অপরাহ্ন ৩১ জানুয়ারি ২০২২ | সংবাদটি ৪৪৪ বার পঠিতওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে,মানবজমিন
অনিশ্চিত যাত্রা। আছে ঝুঁকিও। এরপরও দলে দলে লিবিয়া যাচ্ছে সিলেটিরা। তাদের নিয়ে উৎকণ্ঠার অন্ত নেই। সাগরে নৌকা ডুবলেই শঙ্কা বাড়ে। অপেক্ষা কেবল লাশের। কিন্তু লাশও আসে না। সলিল
সমাধি হয় সাগরেই।
সম্প্রতি সিলেটের তিন জেলার ২৪ জন নিখোঁজ ও আরও বহু তরুণ লিবিয়া থাকার কারণে এমন উৎকণ্ঠা বেড়েছে সিলেটজুড়ে। স্থানীয় সূত্র মতে, হাজারো তরুণ এখন লিবিয়াতে রয়েছে। তাদের অনেকেই রয়েছে জিম্মি, কেউ কেউ কারাগারে। আবার কেউবা সাগরে। ভূমধ্যসাগর। লিবিয়া থেকে ইতালি পৌঁছার অন্যতম রুট। বেলুনের নৌকায় ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর ভাসতে ভাসতে গিয়ে কিনারা হয় ইতালিতে। সম্প্রতি বিয়ানীবাজারের ২৪ যুবক নিখোঁজ হওয়া নিয়ে স্বজনরা সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এই সংবাদ সম্মেলনে লিবিয়া যাওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। স্বপ্নের দেশ ইউরোপ নিয়ে যেতে সিলেটের গ্রামে গ্রামে রয়েছে এজেন্ট। তারা ইউরোপে নিয়ে যেতে সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে ১০-১২ লাখ টাকায় চুক্তি করে। এরপর ভেঙে ভেঙে তাদের লিবিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। আগের রুট ছিল দুবাই হয়ে লিবিয়া। এখন ভারত হয়ে লিবিয়া যাওয়ার নতুন রুট হয়েছে। সম্প্রতি ভারতে গ্রেপ্তার হয়েছে কয়েকজন দালাল। বাংলাদেশ থেকে ভারত কিংবা দুবাই হয়ে বিমানে নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ায়। সেখানে যাওয়ার পর ইউরোপে অভিবাসন প্রত্যাশীরা অসহায় হয়ে পড়েন। তাদেরকে সাগরপাড়ে নিয়ে যেতেই নানাভাবে অত্যাচার করা হয়। দল বেঁধে মরুভূমি দিয়ে রাতের বেলা তাদের নিয়ে যাওয়া হয় সমুদ্র তীরে। আবার অনেককেই আটকে রেখে চাওয়া হয় মুক্তিপণ। বাড়তি টাকা না দিলে মেরে ফেলারও অভিযোগ তোলা হয়। ওখানকার পুলিশও গ্রেপ্তার করে অনেককে। যাদেরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে তাদের খোঁজ মিলে না। বন্দি থাকা অবস্থায় দেশে থাকা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয় না। এমন অবস্থায় পড়া তরুণদের জন্য যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম দালালরা। কিন্তু লিবিয়া নেয়ার পর দালালরাও চরিত্র বদলে ফেলে। সিলেটের স্বজনরা জানিয়েছেন, ইতালিতে পাঠানোর নাম করে লিবিয়ায় সিলেটের ২৫ তরুণকে জিম্মি করে রেখেছিল। এর মধ্যে সে দেশের পুলিশের গুলিতে একজন মারা গেছে। আর বাকি ২৪ জন কোথায় আছে তার কোনো খোঁজ মিলছে না ৭-৮ মাস ধরে। জকিগঞ্জের ঈদগাহ বাজারের বাসিন্দা ফরহাদ হোসেন। তিনি বসবাস করেন ইউরোপের দেশ পর্তুগালে। সেখানে বসেই তিনি সিলেটে আদম ব্যবসা শুরু করেন। স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে বিয়ানীবাজারের ২০ জন, জকিগঞ্জের দু’জন ও বড়লেখার তিনজনকে লিবিয়া হয়ে ইতালি পৌঁছে দিতে ২৫ জনকে নিয়ে যায়। দেশে টাকা পরিশোধের পর কয়েক মাস আগে তাদের লিবিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ওই যুবকদের ট্রলারে করে তাদেরকে ইতালি পাঠানোর কথা। কিন্তু লিবিয়ায় নেয়ার পরই ওদের জিম্মি করে দেশে থাকা পরিবারের কাছে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। অনেকেই দেন মুক্তিপণের টাকাও। কয়েক দফা তারা টাকা দিয়েছেন। বিয়ানীবাজারের ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানান, দালালদের মাধ্যমে যে ২৫ জন তরুণ ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে লিবিয়া পর্যন্ত গেছে। কিন্তু গেল প্রায় ৪ মাস ধরে তাদের কোনো খোঁজ মিলছে না। এর মধ্যে লিবিয়ার ত্রিপোলীর একটি জেল থেকে পালানোর সময় এক তরুণ মারা গেছে। অপর একজন জেল থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু জেল থেকে বের হওয়ার পর সে আবার আরেক দালালের কাছে আটক হয়। ওই দালাল মুক্তিপণ বাবত পরিবারের কাছে থেকে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা আদায় করেছে। এখন ওই তরুণেরও খোঁজ মিলছে না। বিয়ানীবাজারের আতিকুর রহমান জানিয়েছেন, তার ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুনও দালালের মাধ্যমে ইতালিতে যেতে চেয়েছিল। বর্তমানে সে লিবিয়ায় নিখোঁজ রয়েছে। দালালকেও এখন ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ফোন বন্ধ রয়েছে। তার ছেলেসহ এলাকার যারা ইতালি যাওয়ার জন্য লিবিয়ায় অবস্থান করছিল গত চার মাস ধরে তাদের কোন খোঁজ নেই। তবে তাদের ধারণা ওই তরুণরা হয়তো পুলিশের হাতে ধরা পড়ে লিবিয়ার কোনো জেলে বন্দি আছে। তারা বেঁচে আছে বলে তিনি শুনেছেন। এখন দালালের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকার কারণে ওদের সঙ্গে যোগাযোগের সব রাস্তাই বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে, ২০১৯ সালের মে মাসে লিবিয়া থেকে সাগরপথে ইতালি যাওয়ার পথে মারা গেছে সিলেটের ৯ তরুণ। নৌকা ডুবে তারা মারা গেছে। এরপর আরও কয়েকজনের মৃত্যুর খবর এসেছে। সরকারি তরফ থেকে সেই হিসাব মিলে না। কারণ সরকারি চ্যানেলে তারা যায় না। দালালদের ওপর ভরসা রেখেই তারা অনিশ্চিত যাত্রা করে।