সাজানো ঘটনায় গ্রেপ্তার, রিমান্ড তদন্তে নির্দোষ
সিলেটে লন্ডন প্রবাসী মুমিনকে হয়রানি
টাইম সিলেট ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:২৭:০৯,অপরাহ্ন ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | সংবাদটি ৩০০ বার পঠিতধর্ষণ, পর্নোগ্রাফি মামলা। গ্রেপ্তার ও রিমান্ড। এরপর এক মাসের অধিক সময় কারান্তরীণ। সবই গিয়েছে লন্ডন প্রবাসী হাফিজ মাওলানা আব্দুল মুমিন খানের ওপর দিয়ে। শুধু তিনিই নন, তার স্ত্রী মুসলেহা খানমকেও একই মামলায় আসামি করা হয়। এমন ঘটনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন আব্দুল মুমিন খান। কেনই বা তার ওপর এমন অত্যাচার কিছুই জানেন না তিনি। অথচ মান সম্মান হারানোর মামলায় জড়ানো হয় তাকে। কারাগার থেকে বেরিয়ে আইনি লড়াই শুরু করেন।
সত্য ঘটনা প্রকাশে দৌড়াতে থাকেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছেও। শেষে এলো ফলাফল।
তদন্তেই বেরিয়ে এলো নির্দোষ ছিলেন মাওলানা আব্দুল মুমিন খান। বাসার কেয়ারটেকার আব্দুল মালেক জগলু আত্মসাৎকৃত টাকা লোপাট করতে আব্দুল মুমিন খানকে শায়েস্তা করতে নাটক সাজায়। স্ত্রীকে দিয়ে মামলা করিয়ে গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হয়। দীর্ঘ এক বছরের তদন্তে সবকিছু খোলাসা হওয়ার পর স্ত্রী রুমানা বেগমকে পিতার বাড়িতে রেখে পালিয়েছে স্বামী জগলু। হাফিজ মাওলানা আব্দুল মুমিন খান লন্ডনে ইসলামী সেন্টারে শিক্ষকতা করেন। মূল বাড়ি জকিগঞ্জের পইল গ্রামে। সিলেটের মীরবক্সটুলা আজাদী-১ পাঁচতলা বাসার মালিক তিনি।
১১ বছর আগে মাওলানা মুমিন তার গ্রামের স্বজন আব্দুল মালেক জগলুকে মীরবক্সটুলা বাসার কেয়ারটেকারের দায়িত্ব দিয়ে লন্ডনে চলে যান। এরপর তিনি দেশে আসা-যাওয়া করলেও মূলত জগলুই বাসার সব দেখভাল করে। বাসা ভাড়া দেয়া, ভাড়া উত্তোলন করাসহ সব কাজই করতো জগলু। ২০২২ সালের মার্চে লন্ডনে থাকা অবস্থায় হঠাৎ একদিন মাও. মুমিন খবর পান তার বাসায় ঝামেলা হচ্ছে। খবর নিয়ে জানেন জগলু তার স্ত্রী রুমানা বেগমকে মারধর করছে। এলাকার মানুষ বাসা ঘিরে রেখেছে। এ খবর শোনার পর লন্ডন থেকে এলাকার মানুষকে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। পরে তিনি ঝামেলা না করার জন্য কেয়ারটেকার জগলুকে কড়া নির্দেশ দেন।
এরপর থেকে জগলুর নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নজরে আসতে থাকে বাসার মালিক মুমিনের কাছে। লন্ডনে থাকা অবস্থায় নিকটাত্মীয় পাঠিয়ে তিনি ১১ বছরের হিসাব চান। এতে ক্ষেপে যায় জগলু। সে তার স্ত্রী রুমানা ও লন্ডন প্রবাসী মাও. মুমিনের ফটো এডিট করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুৎসা রটাতে থাকে। একপর্যায়ে সে মুমিনকে ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করে। পরে অবশ্য দেশে থাকা স্বজনের মধ্যস্থতায় জগলু তার অপরাধ স্বীকার করে এবং ছবি নিয়ে বানানো অশালীন ভিডিও সরিয়ে নেয়ার লিখিত অঙ্গীকার করে।
একই সঙ্গে বাসার দেনা-পাওনা মিটিয়ে ফেলার কথা বলে সালিশ বৈঠকে আরেকটি লিখিত অঙ্গীকার করে। এই ঘটনাবলী চলার সময় জগলু তার স্ত্রী রুমানা বেগমকে ডিভোর্স দেয়। আর এতে সে অভিযোগ তুলে প্রবাসী মুমিনের সঙ্গে রুমানার সম্পর্ক রয়েছে। এদিকে- জগলুর কাছ থেকে বাসা সমঝে নিতে ২০২২ সালের ১২ই মে দেশে আসেন মাও. মুমিন ও তার স্ত্রী মুসলেহা। ১১ বছরে আদায় করা ভাড়া বাবদ অর্ধকোটি টাকার উপরে দেনা ছিল জগলুর কাছে। এ নিয়ে সালিশ বৈঠক চলমান থাকা অবস্থায় ওই বছরের ২১শে মে রাতে হঠাৎ করে কোতোয়ালি থানা পুলিশের একটি দল মাও. মুমিনকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়।
এরপর থানায় রেখে তারা রাতে রুমানা বেগমের দায়ের করা ধর্ষণ ও পর্নোগ্রাফি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই মামলায় মাও. মুমিনের স্ত্রীকেও আসামি করা হয়। পরদিন পুলিশ আদালত থেকে তিনদিনের রিমান্ডে নিয়ে আসে। মাওলানা আব্দুল মুমিন খান জানিয়েছেন- ‘কেন গ্রেপ্তার হলাম জানি না। পরে শুনলাম আমার কেয়ারটেকারের স্ত্রী রুমানা ধর্ষণ ও পর্নোগ্রাফি মামলা করেছে। এ মামলায় রিমান্ড চলাকালে আমার কাছে প্রস্তাব দেয়া হয়; বাসার একটি ফ্ল্যাট রুমানার নামে, একই সঙ্গে নগদ ৩০ লাখ টাকা এবং রুমানাকে বিয়ে করলে মামলা তুলে নেয়া হবে।’ তিনি জানান- ‘ওই প্রস্তাবে আমি রাজি হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যে ঘটনা আমি ঘটাইনি, সেখানে আমাকে জড়িত করা হয়।’ রিমান্ড শেষে মাও. মুমিনকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তিনি ওই বছরের জুনের শেষ দিকে কারাগার থেকে বেরিয়ে আইনি লড়াই শুরু করেন।
কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়ার আগে আইনজীবীর মাধ্যমে বাদী রুমানাকে ৯ লাখ টাকা দেয়া হয়েছিল। টাকা গ্রহণের পর জামিনে নানা টালবাহানা করেন রুমানা ও তার স্বামী জগলু। এদিকে- রুমানার দায়ের করা মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে অন্য ঘটনা। নেপথ্যে বাসা ভাড়ার টাকা আত্মসাৎ। কোতোয়ালি থানার এসআই মিজানুর রহমান তদন্ত শেষে ২০২২ সালের ১৩ই অক্টোবর পর্নোগ্রাফি মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করেন। এতে মাও. মুমিন ও তার স্ত্রী দোষী প্রমাণিত হননি।
এর ফলে মিথ্যা মামলা দায়ের করায় বাদী রুমানা বেগমের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা হয়। এ মামলা এখন সিলেটের সাইবার ট্রাইব্যুনালে চলমান রয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার এসআই মিজানুর রহমান জানিয়েছেন- মিথ্যা মামলা দায়ের করার কারণে বাদীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ মামলা এখন চলমান রয়েছে। এ ছাড়া ধর্ষণের ঘটনার যে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছিল; ইমিগ্রেশন পুলিশের সহযোগিতায় সে তারিখে আসামি মুমিন ও তার স্ত্রী লন্ডনে ছিলেন বলে তদন্তে প্রমাণ মিলেছে।
এদিকে আদালতে কোতোয়ালি থানা পুলিশের দেয়া রিপোর্টের ওপর আপত্তি জানান মামলার বাদী রুমানা বেগম। বাদীর আপত্তির কারণে পরে মামলাটি তদন্তের জন্য পাঠানো হয় কানাইঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এমদাদুল হকের কাছে। গত ৪ঠা জুন কৃষি কর্মকর্তা আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেন। রিপোর্টে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন- পাসপোর্টে প্রতীয়মান হয়েছে ঘটনার উল্লেখিত তারিখে মাও. আব্দুল মুমিন খান লন্ডনে ছিলেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় শুক্রাণুর উপস্থিতি মেলেনি।
তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়- স্বামী আব্দুল মালেক জগলু ডিভোর্সের এক মাসের মাথায় দ্বিতীয়বার ২০২২ সালের ৬ই জুন রুমানাকে বিয়ে করে। কিন্তু রুমানার স্বামী পূর্বের আত্মসাতের দায় থেকে বাঁচতে এখন পলাতক রয়েছে। মাওলানা আব্দুল মুমিন খানের মামলার আইনজীবী দিলীপ কুমার দাস মানবজমিনকে জানিয়েছেন- বাসা ভাড়া টাকা আত্মসাৎ করতে স্ত্রী রুমানাকে ডিভোর্স দিয়ে পুরো ঘটনা সাজিয়েছিল আব্দুল মালেক জগলু। পরে সে আবার স্ত্রীকে বিয়ে করে। দুটি ঘটনাই তদন্তে মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
এ কারণে পর্নোগ্রাফি মামলার ঘটনায় এখন উল্টো আসামি রুমানা বেগম। আর নারী নির্যাতনের ঘটনার চূড়ান্ত রিপোর্ট আসার পর আদালত মিথ্যা মামলা দায়ের করায় বাদিনীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন। পুরো ঘটনার ভুক্তভোগী হাফিজ মাওলানা আব্দুল মুমিন খান মানবজমিনকে জানিয়েছেন- আমি এখন ন্যায়বিচার চাই। কিন্তু দুটো ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পর এখন রুমানার পক্ষে অনেক সালিশ ব্যক্তিত্ব আদালতের বাইরে ঘটনাটি শেষ করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন- আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এবং নির্দোষ ছিলাম বলেই ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রবাসীরা নিজের সম্পত্তি নিয়ে সিলেটে কী ধরনের হয়রানির শিকার হন, এ ঘটনা উজ্জ্বল প্রমাণ বলে জানান তিনি।