একটি সেতুর অভাবে চরম দুর্ভোগ তিনটি উপজেলার মানুষের!
আবুল কাশেম অফিকঃ
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৪৭:৪৩,অপরাহ্ন ৩০ জুলাই ২০১৯ | সংবাদটি ১৪৫৩ বার পঠিত
সিলেট বিভাগের ঐতিহ্যবাহী তিনটি উপজেলা বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর ও রাজনগর। শীতলপাটির রাজধানী খ্যাত ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানীর স্মৃতি বিজড়িত বালাগঞ্জ, ওসমানী নগর উপজেলা অপরদিকে রাজনগরকে চায়ের দেশও অনেকে বলে থাকেন। এই তিনটি উপজেলাকে কুশিয়ারা নদী ভাগ করেছে। দেশ জাতীর উন্নয়নে অনেক গুরত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে এই দুটি উপজেলার।
দীর্ঘদিন থেকে দুই উপজেলার লাখো মানুষের স্বপ্ন একটি মাত্র সেতু! কবে পূূরণ হবে এই স্বপ্ন? নাকি স্বপ্ন স্বপ্ন’ই থেকে যাবে? এই প্রশ্ন দুই উপজেলা লাখো মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন বালাগঞ্জ টু রাজনগর (বীলবাড়ী) খেয়াঘাট দিয়ে নদী পারাপার হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। নদী পারাপার হতে সবচেয়ে বেশী দুর্ভোগ পোহাতে হয় শিক্ষার্থী, শিশু, রোগী ও তাদের স্বজনরা।
বালাগঞ্জ-রাজনগর সড়কের কুশিয়ারা নদীতে একটি সেতু দু’টি উপজেলার লাখো মানুষের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবী। একটি সেতুর অভাবে যুগের পর যুগ চরম অবহেলায় জীবন যাপন করছে দুই উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের প্রায় দশ লাখ মানুষ। অবহেলিত এই এলাকায় কুশিয়ারা নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণ হলে শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসায়-বানিজ্য,সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ সহ নানান ক্ষেত্রে উন্মোচিত হতে পারে এক সম্ভাবনাময় যুগের। এ অঞ্চলের মানুষের দাবীর প্রতি বিবেচনা করে ২০১৪ সালে তৎকালীন সমাজকল্যান মন্ত্রী মৃত সৈয়দ মহসিন আলী সেতুর ব্যবস্থা হবার আগ পর্যন্ত ফেরি চলাচলের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন বৃটিশ আমলে বাংলাদেশের নৌ’বন্দর গুলোর অন্যতম ছিল কুশিয়ারা তীরবর্তী বালাগঞ্জ-রাজনগর অঞ্চল। বৃহত্তর সিলেটের ব্যবসায়-বানিজ্যের একমাত্র নৌ’বন্দর হিসেবে এর খ্যাতি রয়েছে দেশে-বিদেশে। দেশী-বিদেশী ব্যবসায়ীদের পদচারণায় দিন রাত মুখরিত থাকতো এ অঞ্চল। সে সময় রাস্থা-ঘাট ততটা উন্নত না থাকলেও যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নদী পথের জাহাজ, লঞ্চ, ষ্টিমার ও ইঞ্জিনের নৌকা। তৎকালীন বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা কুশিয়ারা নদী তীরের এ বন্দর থেকে বিভিন্ন পণ্য সংগ্রহ করে ব্যবসায়-বানিজ্য করতেন। সে সময়ে ব্যবসায়-বানিজ্যের পণ্য সংগ্রহের এক মাত্র কেন্দ্রই ছিল কুশিয়ারা তীরবর্তী বালাগঞ্জ-রাজনগরের মধ্যবর্তী অঞ্চল। সময়ের বিবর্তনে এবং দেশের স্থলপথের অভুতপূর্ণ উন্নয়ন হলেও এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসায়-বানিজ্য সহ সকল ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। বছরের পর বছর চরম অবহেলিত এ অঞ্চলের নানান পেশার মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন নৌকা যুগে কুশিয়ারা পার হয়ে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন।
রাজনগরের কুশিয়ারা তীরবর্তী এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো দূরবর্তী হওয়ায় স্কুল/কলেজ মাদ্রাসাগামী কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কুশিয়ারা নদী পার হয়ে বালাগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসা করছে। বিভিন্ন সময় নৌকাডুবির মত মারাত্মক দুর্ঘটনাও ঘটছে।
তাই অবহেলিত এ অঞ্চলের লোকজনের দাবী কুশিয়ারা নদীর উপর একটি ব্রীজ। ব্রীজটি নির্মান হলে শুধু বালাগঞ্জ-রাজনগর নয় পার্শ্ববর্তী ফেঞ্চুগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলার মানুষও উপকৃত হবে। এসব অঞ্চলের মানুষ সিলেট মৌলভীবাজার সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে সহজে যোগাযোগ করতে পারবে।
সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানাযায, উভয় তীরের মানুষের দাবীর প্রেক্ষিতে বিগত ২০১৩ সালের প্রথম দিকে কুশিয়ারা নদী তীরবর্তী বিলবাড়ি অঞ্চলে একটি ব্রীজ নির্মানের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পরিদর্শনে এসেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের প্রকৌশলী অধ্যাপক সুজিত কুমার বালা ও অধ্যাপক তারেকুল ইসলাম। তারা ব্রীজ নির্মানের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য কুশিয়ারা তীরবর্তী বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে তাদের পরিদর্শন রিপোর্টটি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট পেশ করেন। পরিদর্শনের সময় তাদের সাথে ছিলেন বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী, রাজনগর-মৌলভীবাজারের তৎকালীন সংসদ সদস্য ও সাবেক সমাজকল্যান মন্ত্রী মরহুম সৈয়দ মহসিন আলীর প্রতিনিধি সৈয়দ মোস্তাক আলী, বালাগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তাকুর রহমান মফুর, বালাগঞ্জ ও রাজনগর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মাও,আহমেদ বিলাল ও মাও, সৈয়দ আলী আসগর, রাজনগর উপজেলার তৎকালীন প্রকৌশলী রুবাইয়াত জামান, বালাগঞ্জ উপজেলার তৎকালীন প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান সহ উভয় এলাকার বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ।
উল্লেখ্য যে, তৎকালীন সমাজকল্যান মন্ত্রী মরহুম সৈয়দ মহসিন আলী মন্ত্রী হবার পর গত ২০১৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী রাজনগরে তাকে দেয়া এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে এলাকার মানুষের দাবীর প্রেক্ষিতে তিনি ঘোষনা করেছিলেন তিন মাসের মধ্যে রাজনগর-বালাগঞ্জ সড়কে কুশিয়ারা নদীর উপর ফেরির ব্যবস্থা করা হবে এবং তিন বছরের মধ্যে ব্রীজের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু ঘোষণার প্রায় সাড়ে সাত বছর পেরিয়ে গেলেও সরকার আজ অবদি ফেরি কিংবা ব্রীজের ব্যবস্থা করতে পারেনি।
এছাড়াও বিগত ২০১৫ সালের ২৫মে রাজনগরে এক অনুষ্ঠানে কুশিয়ারা ব্রীজের নির্মান কাজ শীঘ্রই শুরু হবে বলে তৎকালীন সমাজকল্যান মন্ত্রী মরহুম সৈয়দ মহসিন আলী পূনরায় ঘোষনা দিলেও তার অকাল মৃত্যুতে ব্রীজটি বাস্তবায়নের মহৎ উদ্যোগ ব্যাহত হয়েছে বলে এলাবাসী মনে করছেন। তারা মনে করছেন সৈয়দ মহসিন আলী বেঁচে থাকলে হয়তো আমাদের এ স্বপ্ন এতদিনে বাস্থবায়িত হয়ে যেত। ওই সময় ব্রীজটি নিমার্ণের ব্যাপারে রাজনগর উপজেলার সাবেক প্রকৌশলী রুবাইয়াত জামান জানিয়েছিলেন, বালাগঞ্জ-রাজনগর রাস্থায় কুশিয়ারা ব্রীজের জড়িপ কাজ শেষে ৪২ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছিল এবং ওই সময়ে তা একনেক সভার এজেন্ডাভূক্ত ছিল। একনেকে প্রস্তাবিত প্রকল্প অনুমোদন সাপেক্ষে যথাযত প্রক্রিয়া শেষে রাজনগর এলজিইডি বিভাগের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন হবার কথা।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ সামাদ চৌধুরী টাইম সিলেটকে বলেন, রাজনগর-বালাগঞ্জ সড়কে কুশিয়ারা নদীতে একটি ব্রীজ নির্মাণের ব্যাপারে আমার সর্বচ্চো প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এ ব্যাপারে বালাগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তাকুর রহমান মফুর বলেন, রাজনগর-বালাগঞ্জ রাস্থায় কুশিয়ারা নদীর উপর ব্রীজ নির্মানের জন্য আমি নিজেও কাজ করছি। কুশিয়ারা নদীর উপর শুধুমাত্র একটি ব্রীজ অবহেলিত এ অঞ্চলের প্রায় লক্ষ লক্ষ মানুষের ব্যবসা-বানিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, আর্থিক উন্নয়ন সহ সর্বক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন সৃষ্ঠি করবে। সম্ভবত একনেকে এই ব্রীজের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
রাজনগর উপজেলা চেয়ারম্যান শাজাহান খান লন্ডন সফরে থাকায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মুক্তি চক্রবর্তী বলেন, যত দ্রুত সম্ভব এ ব্রীজটি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
এব্যাপার আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।