নগরীতে বেপোয়া জুয়াড়ীরা, চলছে তীর আর ঝান্ডুু-মান্ডু খেলা!
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:৪০:০৭,অপরাহ্ন ১৮ আগস্ট ২০১৯ | সংবাদটি ১০১৭ বার পঠিত
সিলেট নগরীর চালি বন্দর ও কালীঘাট এলাকায় কিছুতেই থামছে না ইন্টারনেট ভিত্তিক ভারতীয় শিলং তীর নামক জুয়া খেলা এবং ঝান্ডু-মান্ডু নামক জুয়া। স্থানীয় প্রশাসন মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে এক দু’জনকে আটক করে জেলহাজতে পাঠালেও তারা জামিনে বের হয়ে আবার এ খেলায় বেপরোয়া হয়ে উঠছে। দিনে টোকনের মাধ্যমে তীর খেলা আর রাতে বসে ঝান্ডু-মান্ডু জুয়ার আসর। এই জুয়ার বোর্ড বসিয়ে দিনমজুর থেকে অনেকে হয়ে উঠেছেন কোটিপতি।
জানা গেছে, নগরীর চালিবন্দর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে গেইটের পাশে দোকানের পিছনে একটি কক্ষে তীরের বোর্ড আর একটি কক্ষে ঝান্ডু-মান্ডু বোর্ড বসে। প্রতিদিন দিনরাত চলে জুয়ার জমজমাট আসর। এ দুটি বোর্ডের মালিক চালিবন্দর সমতা-২৪ নম্বর বাসার হানিফ আলীর পুত্র ও যুবদল নেতা নাসিম। কমিশনে তীরের বোর্ড পরিচালনা করে ইসমাঈল এবং ঝান্ডু-মান্ডু বোর্ড পরিচালনা করে আশরাফ। প্রতিদিন এখানে স্কুল পড়–য়ারা অংশ নেন।
এদিকে, কালিঘাটের বস্তাপট্টি নামক মার্কেটে নিচ তলায় রড-সিমেন্টসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকান। দুটি গলির একটু ভিতরে গেলে দেখা যায় দু’তলার ছাদের সিঁড়ি। বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠলেই ছাদের এক পাশে রাখা পলিথিন ও পাটের বস্তার বান্ডিল। তাই এই মার্কেট সবার কাছে ‘বস্তা মার্কেট’ নামে পরিচিত। অপর পাশে দুটি চেয়ারে বসে আছেন দু’জন যুবক। নাম বড় জামাল ও ছোট জামাল। টেবিলে আছে কাগজের কিছু টুকরো। গ্রাহকরা আসছেন সারি বেঁধে। চেয়ারে বসা যুবকরা তাদেরকে ১০/২০/৫০/৩০০ টাকার বিনিময়ে একটি টোকেন দিচ্ছেন। কেউবা নিচ্ছেন কয়েকটি। এমনকি কেউ কেউ একসাথে ২০টি টোকেনও নিচ্ছেন। এ যেন কোনো যানবাহনের অথবা চিকিৎসকের টিকিট কাউন্টার। কিন্তু আসলে এই টোকেন হচ্ছে শিলং তির খেলার। একই জায়গায় সন্ধ্যার পর চিত্র অন্যটি। সন্ধ্যার পর বসে ঝান্ডু-মান্ডু জুয়া আসর। দল বেধেঁ জুয়াড়িরা ঝান্ডু-মান্ডুর খেলেন। এই জুয়ার বোর্ডের নেতৃত্ব দেন ছাত্রদলের শরীফ আহমদ। কালীঘাটের বোর্ডের শরীফের সহযোগী বড় জামাল ও ছোট জামাল দিনে তীর শিলং ও রাতে ঝান্ডু-মান্ডু জুয়ার আসর বসান। কালীঘাটের ‘ডাইল পট্টি’ মার্কেটের পিছনে নদীর পারে টিনসেডের ঘরে দিন রাত চলে ঝান্ডু-মান্ডু জুয়ার আসর। এখানেও শরীফের সহযোগী মাছুম, ছেন্টু ও মঞ্জু এই জুয়ার আসর পরিচালনা করেন। শরীফ ৫ বছর আগে একটি কাপড়ের দোকানে চাকরী করতেন। কিন্তু জুয়ার বোর্ডের অদৃশ্য টাকায় এখন তিনি কোটিপতি। নগরীতে রয়েছে তার ৩ তলা বাসা, রয়েছে দুদুটি দামী গাড়ি। অপরদিকে, দক্ষিণ সুরমায়ও থেমে নেই ইন্টারনেট ভিত্তিক তীর জুয়া ও টিকিটিকি নামক জুয়া। দক্ষিণ সুরমার রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেয়াল ঘেষে পসরা সাজিয়ে বসেছে এসব জুয়ার বোর্ড। বিদ্যালয়ের দেয়াল ঘেষে রয়েছে একটি চায়ের দোকান। দোকানের মালিক মিন্টু মিয়া নাকি এই জুয়া খেলার অপরাধে দীর্ঘদিন কারাভোগও করেছেন। কিন্তু দোকানের ভেতরে ঢুকলেই অন্যজগত। টিভিতে চলছে বিশ্বকাপ আর ক্রিকেট টেবিলে বসা লোকজন প্রতি ওভারে প্রতি বলে ধরছেন বাজি। দোকানের পেছনকার দৃশ্য আরো ভয়ানক। চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে আছে দুই যুবক কাটছে তীর জুয়ার নাম্বার। দোকানটির ঠিক উল্টোপাশে রয়েছে মস্তকিন নামে আরেক জনের চায়ের দোকান। সেখানকার অবস্থা একই। এ বোর্ডগুলির সাথে জড়িত রয়েছে এলাকার প্রাভাবশালীরাও। দিলোয়ার, মিন্টু, জাহেদ, ফরিদ, মস্তকিন, ইব্রাহীমসহ এই বোর্ডে রয়েছে আরো অনেক পার্টনার। এদের মূল কাজই হচ্ছে জুয়ার বোর্ড বসানো। বেপরোয়াভাবে জুয়ারীদের মদদ দিচ্ছে এক প্রকার অসাদু পুলিশ, হলুদ সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদরা। তাদের ছত্রছায়ায় কিছুতেই বন্ধ হচ্ছেনা এই জুয়ার বোর্ডগুলি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীর কোতোয়ালী থানাধীন সোবহানীঘাট পুলিশ ফাঁিড় ও বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ির কিছু অসৎ পুলিশ এসব জুয়াড়িদের কাছ থেকে অবৈধভাবে সুবিধা নেয়াই এই শিলং নামে জুয়া খেলা কিছুতেই থামছে না। যার ফলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যে তীর খেলা বন্ধে অভিযান চললেও কোনো সুফল মিলছে না। সাম্প্রতিক সময়ে চালি বন্দর ও কালিঘাট এলাকায় শিলং তীর এবং ঝান্ডুু-মান্ডু খেলার উৎপাত দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় সচেতন মহল উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। চালি বন্দরে প্রকাশ্যেই চলছে শিলং তীর খেলার টোকেন বিক্রি। নারী-পুরুষ দল বেঁধে এই তীর নামক জুয়া খেলায় লাভের আসায় প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে। লাভতো দূরের কথা প্রতিনিয়ত এসব খেলে অনেকেই নি:স্ব হচ্ছে। নগরীর সুরমা মার্কেটের বড় এজেন্টের মাধ্যমে চালি বন্দরের এজেন্টদের সঙ্গে জুয়ার আসরের সমন্বয় করে থাকে। আর ভারতীয় এ ভাগ্যেও খেলায় স্কুল-কলেজের ছাত্র, দিনমজুর, রিকশাচালক, যানবাহন চালক-শ্রমিকসহ বেকার যুবকরা বেশি অংশ নিচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আজ থেকে ৩০ বছর আগে ভারতীয় ধনকুবেররা এ রকম খেলাটি আবিষ্কার করেছিল। এর নাম রাখে মেঘালয়ের আঞ্চলিক ভাষায় ‘তীর খেলা’। এই শিলং তীর খেলাটির নিয়ম হচ্ছে এদেশের এজেন্টদের মাধ্যমে ০-৯৯ পর্যন্ত নম্বর বিক্রয় করা হয় ১০ টাকা থেকে শুরু করে যেকোনো মূল্যে। লটারিতে ০ থেকে ৯৯ পর্যন্ত কোনো সংখ্যা কিনে নেওয়া যায়। সর্বনিম্ন ১০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বাজি ধরা হয়। যত মূল্যে সংখ্যাটি বিক্রয় করা হয় তার ৭০ গুণ লাভ দেয়া হয় বিজয়ী নম্বরকে। অর্থাৎ, ১০ টাকায় ৭০০ টাকা। একই নম্বর এশাধিক লোকও কিনতে পারেন। সবাই কেনা দামের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি টাকা পাওয়ার লোভে এই শিলং নামে জুয়ায় বাজি ধরছেন। প্রতিদিন বিকাল সোয়া ৪টায় ও সাড়ে ৫টায় ও রাত সাড়ে ১০টায় এ লটারির ড্র অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। খেলার ফলাফল দেওয়া হয় অনলাইনে। ভারতের শিলং থেকে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জুয়ার আসরটি পরিচালনা করা হয়। আর এ ওয়েব সাইটের মাধ্যমে এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোনেও ফলাফল জানা যাচ্ছে। আর এসব জুয়ার নেতৃত্বে রয়েছে এলাকার প্রভাবশালী কিছু লোকজন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, এনড্রয়েড ফোন সেটের মাধ্যমে নম্বর বইয়ের মালিকরা দেখান ও রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে নম্বর টোকেন বিক্রি করেন।
এই খেলাটি চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ করতে প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্থক্ষেপ কামনা করছেন স্থানীয় সচেতন মহল। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী কিছু দিন আগে উচ্ছেদ করেন। এরপর কয়েকদিন পর থেকে জুয়াড়ীরা আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠে। জুয়াড়ীরা হচ্ছে সাইফুল, মিজান, নাসিম, কুমিল্লার নজরুল তারাই হচ্ছে বোর্ডের মালিক।
শরীফের সহযোগী বড় জামালের সাথে আলাপ করলে সে বলে, এই বোর্ডের মালিক ছাত্রদলের শরীফ আহমদ। আমরা কমিশনে কাজ করি। আপনি কোনো কিছু বলতে হলে তাকে বলেন। একই বক্তব্য ছোট জামালের।
পুলিশ সূত্রমতে, গত কয়েক মাসে সিলেটে অন্তত শতাধিক জুয়ার আসর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আর এই অভিযানে সবচেয়ে বেশি প্রশংসার দাবিদার মহানগর পুলিশ। কিন্তু জুয়ার আসর বন্ধ করা হলেও ফাঁড়ি ও কিছু অসাধু পুলিশের মাঠপর্যায়ের সদস্যদের কারণে এসকল জুয়া খেলা ফের ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো সিলেটের আনাচে-কানাচে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালনা করেও দমন করা যাচ্ছে না এসব জুয়া। কারণ জুয়া খেলায় আটক হলে সাজা কম হয়। গ্রেপ্তারের পর জামিনে বের হয়ে পুনরায় ওই খেলায় জড়িয়ে পড়ছেন জুয়াড়িরা। আর এসব কারণে নিয়মিত অভিযান চললেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ উপ-কমিশনার (মিডিয়া) জেদান আল মুসা বলেন, এসব জুয়া খেলার বিরুদ্ধে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। জুয়াড়িদের আটকে পুলিশি অভিযান অব্যাহত আছে। আজ থেকেই ফের অভিযান চলবে। আর কোন পুলিশ সদস্য জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি আরও বলেন, যারা এই জুয়া খেলে তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে খেলে তাই তীর খেলা নির্মূল করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মানুষ সচেতন হলেই এই খেলা বন্ধ হবে।