ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আর নেই

টাইম ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১:১৯:১৬,অপরাহ্ন ১৭ মার্চ ২০২১ | সংবাদটি ৩৯১ বার পঠিতচলে গেলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)।
পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, উপ-প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালন করা মওদুদ আহমদের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, খুব বেদনার সঙ্গে জানাচ্ছি, মওদুদ আহমদ আর নেই। তার মৃত্যুতে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। দেশ একজন অভিভাবকতুল্য নেতাকে হারিয়েছে। বিএনপি গভীরভাবে শোকাহত।
মওদুদ আহমদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ শোক প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। শোক জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
১৯৯৬ সালে বিএনপিতে ফেরার পর আমৃত্যু দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন প্রবীণ আইনজীবী মওদুদ আহমদ। তার একান্ত সহকারী মোমিনুর রহমান সুজন সমকালকে জানিয়েছেন, মওদুদ আহমদের মরদেহ দেশে আনার সময়সূচি এখনও ঠিক হয়নি। হাসপাতালে তার সহধর্মিণী হাসনা মওদুদ আছেন।
তাদের মেয়ে নরওয়ে আছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির আলোচিত চরিত্র ৮১ বছর বয়সী মওদুদ আহমদ কিডনি, ফুসফুসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছিলেন। গত ২৯ ডিসেম্বর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে দেশে চিকিৎসা নেন। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে ২০ জানুয়ারি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন। পরদিনই ফের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ১ ফেব্রুয়ারি নেওয়া হয় সিঙ্গাপুরে। মোমিনুর রহমান জানিয়েছে, ক’দিন ধরেই আইসিইউতে ছিলেন মওদুদ আহমদ। তার অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল। ফুসফুসে পানি জমছিল। এতে অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতা কমে যায়, কিডনিও ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছিল।
ছয়বারের এমপি মৃদুভাষী মওদুদ আহমদ দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে খ্যাত ছিলেন। বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাস মওদুদ আহমদ আইনজ্ঞ হিসেবেও খ্যাতিমান ছিলেন। ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য আসামিদের আইনজীবী দলের সদস্য ছিলেন। একাত্তরে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সহায়ক দলে ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারে যোগ দেন। বহির্বিশ্বে পাকিস্তানি গণহত্যা তুলে ধরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার মওদুদ আহমদকে পোস্ট মাস্টার জেনারেল পদে নিয়োগ দেয়।
১৯৭৪ সালে ৩৩ নাগরিক মিলে কমিটি ফর সিভিল লিবারটিস অ্যান্ড লিগ্যাল এইড গঠন করেন মওদুদ আহমদ। এ কমিটি জরুরি অবস্থা জারির সমালোচকসহ বিরোধী রাজনীতিকদের আইনি সহায়তা দিত। ওই বছরের ডিসেম্বরে কারাগারে যান মওদুদ আহমদ। তবে দ্রুতই ছাড়া পান। ১৯৪০ সালে ২৪ মে নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করা মওদুদ আহমদ সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সরকারে যোগ দেন। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৯ সালে জন্মস্থান নোয়াখালীতে প্রথমবার এমপি হন। জিয়াউর রহমানের সরকারে মন্ত্রী ও পরে উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়া আবদুস সাত্তারের সঙ্গে মতবিরোধ তৈরি হয় মওদুদ আহমদের। আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে ক্ষমতা নেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদের সামরিক শাসনের কড়া সমালোচকদের একজন ছিলেন মওদুদ। দুর্নীতির মামলায় সামরিক আদালত তাকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেন। কিন্তু ১৯৮৫ সালে এরশাদের সরকারে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হন। পরে প্রধানমন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতিও হন। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে তিন জোটের রূপরেখায় উপ-রাষ্ট্রপতি পদ ছাড়েন।
মওদুদ আহমদ একানব্বই সালে জাতীয় পার্টি থেকেই এমপি হন ওবায়দুল কাদেরকে হারিয়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সেই সময়কার বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অগ্রণীদের একজন ছিলেন। ‘৯৬ সালে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে হেরে যান। জাতীয় পার্টি ছেড়ে ফিরে আসেন বিএনপিতে। ২০০১ সালে এমপি ও খালেদা জিয়া সরকারের আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেওয়া বগুড়া-৭ আসন থেকে উপনির্বাচনে জিতে এমপি হন।
মওদুদ আহমদ পাকিস্তান আমল, বঙ্গবন্ধু সরকার, এরশাদ সরকার, ওয়ান ইলেভেন ও মহাজোট সরকারের সময়ে জেল খেটেছেন। কারাগারে বসে তিনি ডজনের বেশি বই লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে- ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট :এ স্টাডি অব পলিটিক্স অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশনস ইন বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ :এরা অব শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ কনস্টিটিউশনাল কোয়েস্ট ফর অটোনমি’, ‘বাংলাদেশ :ইমারজেন্সি অ্যান্ড দ্য আফটারম্যাথ’ ইত্যাদি। বাংলাদেশের রাজনীতি ও নেপথ্য ঘটনাপরম্পরা বিশ্নেষণে বইগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ দলিল বলে গণ্য করা হয়।
মওদুদ আহমদ ছিলেন শিক্ষকও। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন এলিজাবেথ হাউস, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফায়ার্স, ফেয়ারব্যাংক এশিয়া সেন্টার এবং হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান ইনস্টিটিউটের ফেলো ছিলেন। ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে এলিয়ট স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফায়ার্সের ভিজিটিং প্রফেসর।