হাওর রক্ষা বাঁধের অর্ধেক টাকাই লুট
টাইম সিলেট ডট কম
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৩২:২৭,অপরাহ্ন ২১ এপ্রিল ২০২২ | সংবাদটি ৩৪৭ বার পঠিত
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে,হাওরে সর্বশেষ বাঁধ ভেঙে ফসলহানি হয়েছিল ২০১৭ সালে। এরপরের চার বছর পানিও আঘাত হানেনি, ফসলেরও ক্ষতি হয়নি। তবে- করোনার ছোবল ছিল। ২০১৮-২০২১ সাল চার বছরে হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ হয়েছে ৪৪৩ কোটি টাকার। তার উপর ১২২ কোটি টাকার বাঁধ নির্মাণ কাজে ছিল সংশ্লিষ্টদের গাফিলতিও। টাকার মোহে অন্ধ হয়ে পড়েছিলেন পিআইসি কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ফলে সুনামগঞ্জের হাওর রক্ষা বাঁধ এবার শুরুতে কয়েক ঘণ্টার ঢলে তাসের ঘরের মতো উড়ে যায়। হাওরে প্রতি বছরই সরকারের তরফ থেকে বাঁধের জন্য টাকা বরাদ্দ করতে হয়।
বৈশাখের উজানের ঢল থেকে রক্ষা পেতে শতকোটি টাকার বাঁধ রক্ষা কাজের স্থায়িত্ব থাকে মাত্র কয়েক মাস। এরপর হাওরের পানি টান পড়লে সেই বাঁধগুলোও একেক করে কেটে দেয়া হয়। এজন্য প্রতি বছরই নতুন করে শ’শ’ কোটি টাকা সরকারকে খরচ করতে হয়। হাওরের ফসল এবং জৈব বৈচিত্র রক্ষার স্বার্থে সরকারের তরফ থেকে স্থায়ী কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারছে না। গত ৪ বছর হাওরে ঢল আসেনি; এ কারনে এবারো ঢল আঘাত হানবে না- এমন ধারণা ছিল বাঁধ নির্মাণ সংশ্লিষ্টদের। এজন্য তারা বিগত চার বছরের মতো এবারো দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। কৃষক জানিয়েছেন- নিয়ম রয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে কৃষক প্রতিনিধি রাখা হবে। কিন্তু সেটি মানা হয়নি। কাজ শেষ করার কথা ছিল ফেব্রুয়ারির মধ্যে। কিন্তু এপ্রিলে এসেও সেই কাজ চলমান। প্রকল্পে কাজে ছিল ধামাচাপা দেয়া। নিয়ম হচ্ছে- প্রকল্পের মাটি নিয়ে আসতে হবে দূরবর্তী স্থান বা নদী থেকে। কিন্তু খালের পাড়ে সড়ক
নির্মাণের মতো বাঁধের নিচ থেকে মাটি এনে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ঘাস লাগানোর কথা বাঁধ নির্মাণের পরপরই। কিন্তু সেটিও হয়নি। বিলম্বে শুরু করে বিলম্বে বাঁধ নির্মাণের কারণে একদিনের ঢলেই সব শেষ গেছে। আর দ্বিতীয় ধাক্কায় গ্রামের লোকজন, কৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃষক বিনাশ্রমে কাজ করে কিছুই করতে পারেননি। হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সালেহীন চৌধুরী শুভ হাওরের এই দুর্গতির জন্য প্রক্রিয়াকেই বেশি দায়ী করেন। তার মতে- চলতি বছর বাঁধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে। গত ৫ বছর ধরে দুর্নীতির এই ধারা চলমান। এবার গাফলাতিও ছিল। আগের মতো লুটেপুটে প্রকল্পের টাকা খেতে তারা নিয়ম না মেনেই কাজ করেছে।
তিনি বলেন, হাওর রক্ষা বাঁধের প্রকল্প গ্রহণ থেকে শুরু করে সব কিছু স্থানীয় ইউএনওদের নেতৃত্বে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সরকার এটিকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচিত করলেও মাঠ পর্যায়ে হচ্ছে ভিন্ন চিত্র। এই প্রক্রিয়ায় জড়িতরাই দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এদিকে- এবার সুনামগঞ্জে হাওর রক্ষা বাঁধেই বরাদ্দ এসেছিল ১২১ কোটি টাকা। কৃষকসহ সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন- এবারো মোট বরাদ্দের অর্ধেক টাকা দুর্নীতি হয়েছে। হাওরে বাঁধ নির্মাণে ইউএনওদের উপর সরাসরি এমপিদের তদবির কিংবা নির্দেশনা থাকে। এ কারণে স্থানীয় এমপি ও দলীয় নেতাকর্মী
এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মিলে এসব টাকা লুটে নিয়েছেন। পূর্বের দেয়া বাঁধকে প্রকল্প দেখিয়ে টাকা লুটের ঘটনাও রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট বিভাগের চিফ ইঞ্জিনিয়ার এসএম শহীদুল ইসলাম মানবজমিনকে জানিয়েছেন, হাওরের বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে কিনা, সে ব্যাপারে তদন্ত চলছে। এবার বাঁধ নির্মাণের অর্ধেক টাকা দেয়া হয়নি। সুতরাং তদন্ত রিপোর্টের আলোকে সেই টাকা দেয়া হতে পারে। এ নিয়ে সরকারের উচ্চ মহল ওয়াকিবহাল বলে জানান তিনি। শহীদুল ইসলামের মতে- সুনামগঞ্জের প্রধান হাওর টাঙ্গুয়াতে এখন পানি বৃদ্ধি ছাড়া কমছে না। ফলে তলিয়ে যাওয়া ধান আর ঘরে নাও উঠতে পারে। তবে- কৃষক চেষ্টা করছেন তলিয়ে যাওয়া আধাপাকা ধান ঘরে তুলতে। পাউবো সূত্রে জানা গেছে; সুনামগঞ্জে ২০১৮
থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধের ৪৪৩ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বরাদ্দ ছিল ২০১৮ সালে ৯৬৫টি প্রকল্পে ১৫১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে ৫২৭টি প্রকল্পে ৮০ কোটি টাকা, ২০২০ সালে ৭৪৪টি প্রকল্পে ১০২ কোটি, ২০২১ সালে ৮১০টি প্রকল্পে ১০৯ কোটি টাকা। এবার ৭২৭টি প্রকল্পে ১২১ কোটি টাকার ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ হয়েছে। এই বাঁধের নির্মাণ কাজের সময়সীমা ছিল ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
হাওরে বাঁধের কাজের নীতিমালা অনুযায়ী, স্থানীয় কৃষক ও সুবিধাভোগীদের নিয়ে পাঁচ থেকে সাত সদস্যের পিআইসি গঠন করা হয়। একটি পিআইসি সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকার কাজ করতে পারে। এবার সুনামগঞ্জে ৭২৭টি প্রকল্পে, পিআইসির অধীনে ১২২ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৫৪টি হাওরে এবার ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এতে ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকার বোরো ধান উৎপাদিত হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু পানিতে তলিয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন, সেই ফসল। সিলেটে এবার ঢল নামলে ফসলহানীর শঙ্কা আগে থেকেই করেছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ও পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা। এ নিয়ে তারা হাওরে গবেষণাও চালিয়েছিলেন।
এরপর সেই গবেষণা তুলে ধরেছিলেন গণমাধ্যমের কাছে। পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা জানিয়েছেন, বাঁধে বরাদ্দের অর্ধেক কোথাও কোথাও খরচ হয়েছে, কোথা কোথাও হয়নি। কারণ- বাঁধ নির্মাণে যে প্রক্রিয়া ফলো করার কথা ছিল সেটিও করা হয়নি। এজন্য ক্ষতি হয়েছে বেশি। এদিকে, তাদের গবেষণায় উঠে এসেছিল নির্ধারিত সময় ২৮শে ফেব্রুারির মধ্যে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ মাত্র ৬২ ভাগ শেষ হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন প্রক্রিয়া সঠিক নয় বলে ৫৮ ভাগ মানুষ মনে করে। রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে পিআইসি গঠিত হয়েছে। এবার তারা সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় দৈবচয়ন পদ্মতিতে ১০৮টি বাঁধের উপর তারা এ জরিপ পরিচালনা করেন। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী তারা দেখেছেন; মাত্র ৮ ভাগ বাঁধে মাটির কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
ঘাস লাগানো হয়েছে ৩ ভাগ বাঁধে। সংশোধিত কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী ৫০ মিটার দূর থেকে বাঁধের মাটি আনার কথা থাকলেও ৩৫ ভাগ বাঁধে এই নিয়ম মানা হয়নি। যেসব বাঁধে মাটির কাজ সম্পন্ন করা হয়নি এসব বাঁধে মাটি দুরমুজ (কম্পেকশন) ও ঢাল বজায় রাখার কাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী ২৮শে ফেব্রয়ারি পর্যন্ত ৫২ ভাগ বাঁধে ২:১ ঢাল বজায় রাখা হয়নি। যা নীতিমালা অনুযায়ী থাকার কথা। ১৮ ভাগ বাঁধে মাটি দুরমুজ করা হয়েছে।
নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ার কারণ হিসেবে প্রকল্প প্রাক্কলন ও পিআইসি গঠনে বিলম্ব, অর্থ ছাড়ে বিলম্ব, হাওর থেকে দেরিতে পানি নামা ও ড্রেজার মেশিনের স্বল্পতার কথা উল্লেখ করেন। জামালগঞ্জের পাকনাও হাওরের তীরবর্তী স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন- পাকনাও হাওরে ৪টি বাঁধের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। এজন্য ইউএনও পক্ষ থেকে সেই বাঁধ নির্মাণের অনুমতিও দেয়া হয়নি।
এসেছে বা আসছে সবগুলোই তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সব অভিযোগই আমলে নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।